নীতির চেয়ে দেশের স্বার্থকেই বড় করে দেখলেন বাইডেন

0
100
হোয়াইট হাউসে গতকাল বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর চাপ ছিল প্রবল। দাবিও। দলের, নাগরিক সমাজের, সংবাদমাধ্যমেরও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি দেশের বিপুল বাণিজ্যিক স্বার্থ ও কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপনকেই বেশি প্রাধান্য দিলেন।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলাপচারিতায় ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিপীড়ন, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ ও সার্বিকভাবে গণতন্ত্রের নিম্নগামিতা নিয়ে তাঁদের ধারণা ও আপত্তির লেশমাত্র অবতারণাও প্রকাশ্যে করলেন না; বরং সে–সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘দুই দেশের ডিএনএতেই গণতন্ত্র রয়েছে।’

সে সুযোগে প্রকাশ্যে প্রশ্নের জবাবে দেশের গণতন্ত্রের জয়গান গেয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি জানিয়ে দিলেন, ‘ভারত গণতান্ত্রিক দেশ; কোনো ধারণামাত্র নয়। ভারতের ধমনিতে গণতন্ত্র রয়েছে। ভারত গণতন্ত্রে বাঁচে। সংবিধানেও তা প্রতিফলিত। সরকারও গণতন্ত্রকেই আঁকড়ে আছে। কোনো সরকারি নীতিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নিয়ে কোনো বৈষম্য নেই।’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই মোদি উচ্চারণ করেন সেই স্লোগান, যা তাঁর সরকারের ঘোষিত ধর্ম, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ।’

মোদির এই সফর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দুটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটি ব্যবসা-বাণিজ্যের বাজার বৃদ্ধি, অন্যটি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ভারতকে এমনভাবে সাহায্য করা, যাতে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের মোকাবিলা সহজতর হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদির দিক থেকে আগ্রহ ছিল অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষায় ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি দেশের সীমান্ত সুরক্ষিত করা ও দেশের রাজনীতিতে নিজের অধিষ্ঠান প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া।

পারস্পরিক এই চাহিদা ও লক্ষ্য পূরণের মধ্যে চাপা পড়ে গেল গণতান্ত্রিক আদর্শ, নীতি ও মূল্যবোধ। প্রকাশ্যে বোঝার কোনো অবকাশ রইল না, ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বাইডেন ভারতের স্খলিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে যথেষ্ট দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

তিন দিনের সফরে দুই দেশই তাই পারস্পরিক লক্ষ্যগুলো পূরণের দিকে বেশি নজর দিয়েছে। প্রতিরক্ষা চুক্তি, সেই চুক্তির মধ্য দিয়ে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানের পথ সুগম করার পাশাপাশি মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির বিস্তারলাভের দিকে যেমন দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে, তেমনই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মহাকাশ, টেলিযোগাযোগ, সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ তৈরির মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দিকে।

মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বাড়াতে ভারতের বেঙ্গালুরু ও আহমেদাবাদে যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত দুটি কনস্যুলেট খুলবে যেমন, তেমনই সিয়াটলে ভারত খুলবে আরও একটি কনস্যুলেট।

ভারতীয় ডকে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জাহাজ মেরামতির বন্দোবস্ত করতেও দুই দেশ রাজি হয়েছে। সর্বোপরি রয়েছে ৩০০ কোটি ডলারের ৩০টি অত্যাধুনিক সশস্ত্র ড্রোন কেনার বিষয়টিও। বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মোদি নিজ রাজ্য গুজরাটের স্বার্থও দেখেছেন। সেমিকন্ডাক্টর তৈরির শিল্প সেখানেই গড়ে তোলা হবে, যাতে লগ্নি হবে ২৭৫ কোটি ডলার।

পারস্পরিক এই স্বার্থসিদ্ধিই যে মূল লক্ষ্য, তা অনুমেয় ছিল। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে নীতি ও আদর্শগত বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।

বাইডেন-মোদি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা আগে গতকাল বৃহস্পতিবার সিএনএন তাঁর যে সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করেছে, তাতে ওবামা সোজাসাপটা বলেছিলেন, কূটনৈতিক আলোচনায় মুসলমানদের নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরা উচিত।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বাধ্যবাধকতার বিষয়টি পরিষ্কার করে জানিয়েও ওবামা ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, প্রেসিডেন্টকে অনেক কিছুর খেয়াল রাখতে হয়। চীন ও ভারত—দুই দেশের সঙ্গেই ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার দিকেও নজর রাখতে হবে। দুই দেশই গুরুত্বপূর্ণ। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি আমিও করেছিলাম। চীন ও ভারতকে সহমত করিয়েছিলাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও পারস্পরিক আলোচনায়, নিভৃতে অথবা প্রকাশ্যে, নীতি ও আদর্শজনিত বিড়ম্বনা তুলে ধরা উচিত।

ওবামা বলেন, মোদির সঙ্গে কথা হলে আমি এটাই বলতাম, সংখ্যালঘুদের স্বার্থ না দেখলে একটা সময় দেশটা ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। তাতে হিন্দু ভারতেরও মঙ্গল হবে না।

বাইডেনের ওপর এ ধরনের চাপ তৈরি করেছিলেন তাঁরই দলের ৭৫ কংগ্রেস সদস্য। শীর্ষ সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তেও লেখা হয়েছিল, আড়ালে বলা হলেও শালীনতা লঙ্ঘন না করে প্রকাশ্যেও কিছু বলা প্রয়োজন, যাতে মানুষ বুঝতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি ঠিক কোথায়। সাংবাদিকের প্রশ্নও ছিল তা নিয়ে। কিন্তু বাইডেন জবাবে যা বললেন, তাতে উদ্বেগের লেশমাত্র প্রতিফলন ছিল না।

বরং অতিশয় সাবধানী ও সতর্কভাবে বাইডেন জবাব দেন, গণতন্ত্র নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে তাঁর মুক্তমনেই আলোচনা হয়ে থাকে। এবারও ভালো আলোচনা হয়েছে। দুই দেশই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ও শ্রদ্ধাশীল।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যে যুগ্ম বিবৃতি প্রচার করা হয়, তাতে অবশ্য গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বহুত্ববাদের উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে, দুই দেশই স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সবার অন্তর্ভুক্তি, বহুত্ববাদ ও সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকারের মূল্যবোধে বিশ্বাসী। সেই বিশ্বাস অটুট রাখবে। দুই দেশই তার বিপুল বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে আসছে। লালনও করছে। এগুলোই বিশ্বশান্তি ও টেকসই উন্নয়নের আধার।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.