সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে আইন ভেঙে স্থাপনা নির্মাণ

0
72
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতরে নির্মাণাধীন পাকা দোকানঘর

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দেশের অন্যতম জাতীয় উদ্যান হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি বনে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। ওই উদ্যানে রেস্তোরাঁ ব্যবসা করার জন্য স্থাপনা দুটি নির্মাণের কাজ চলছিল। পর্যটকদের সুবিধা দেওয়ার অজুহাত দেখিয়ে ওই উদ্যানের সহব্যবস্থাপনা কমিটি স্থাপনাগুলো নির্মাণের অনুমতি দেয়। অবশ্য অভিযোগ পেয়ে চুনারুঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গত সোমবার এসব স্থাপনার নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন।

পরিবেশবিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় উদ্যানের ভেতরে রেস্তোরাঁ নির্মাণ করা হলে লোকসমাগম বাড়বে। এতে বনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।

পরিবেশবিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় উদ্যানের ভেতরে রেস্তোরাঁ নির্মাণ করা হলে লোকসমাগম বাড়বে। এতে বনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। এ অবস্থায় এই স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

এ বিষয়ে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ হবিগঞ্জের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তিনি এখানে নতুন যোগ দিয়েছেন। বনের ভেতরে এ ধরনের পাকা বা স্থায়ী ঘর নির্মাণের বিধান নেই। তবে কী করে আগে এ অনুমোদন দেওয়া হলো, কিসের ভিত্তিতে কাজ হচ্ছে, তা দেখতে হবিগঞ্জের সহকারী বন কর্মকর্তাকে বিষয়টি তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতরে নির্মাণাধীন পাকা দোকানঘর
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতরে নির্মাণাধীন পাকা দোকানঘর

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ১৮টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে সাতছড়ি অন্যতম। এখানে ১৯৭ প্রজাতির পশুপাখি রয়েছে। এর মধ্যে ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির উভচর। এটি বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং পাখিদের একটি অভয়াশ্রম। এই উদ্যানে লজ্জাবতী বানর, উল্লুক, চশমাপরা হনুমান, কুলু বানর, মেছো বাঘ, মায়া হরিণ বাস করে। এর আয়তন প্রায় ৬০০ একর। এই উদ্যানের মধ্যে সাতটি ছড়া বা ঝরনা আছে। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে সাতছড়ি।

সরকার আইন করে জাতীয় উদ্যান করা হয়েছে, এমন বনে কোনো দোকান, ‘কটেজ’ বা হোটেল নির্মাণ নিষিদ্ধ করেছে। এ বিষয়ে বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২-এর ১৬(২)-এর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কোনো বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য কোনো পর্যটন দোকান, কটেজ বা হোটেল নির্মাণ ব্যতীত রাস্তা, সেতু, ভবন, বেষ্টনী বা প্রতিবন্ধক প্রবেশতোরণ নির্মাণ ও সীমানা চিহ্নিতকরণ অথবা এই ধরনের অন্যান্য কাজ যা অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আবশ্যক, তা করিতে অনুমতি প্রদান করিতে পারিবেন।’ এই আইনের জাতীয় উদ্যান ঘোষণাবিষয়ক ১৭ নম্বর ধারায়ও জাতীয় উদ্যানেও বাণিজ্যিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

২ মে সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকা-সিলেট পুরাতন মহাসড়কের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের একটি ছড়ার পাশে ৪ শতাংশ জমিতে পাকা দুটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। দুটি ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে চারটি করে কক্ষ করা হচ্ছে। নির্মাণাধীন ভবন দুটির আগ থেকে আরও একটি ঘর নির্মাণ করে রেস্তোরাঁ ব্যবসার জন্য ভাড়া দেয় বন বিভাগ। সেখানে আরও দুটি দোকানঘর আছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভবন দুটি নির্মাণ করছেন সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ত্রিপুরাপল্লির বাসিন্দা আকাশ দেববর্মা ও মাধবপুর উপজেলার নয়াপাড়া গ্রামের মাসুম বিল্লাহ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা দাবি করেন, বন বিভাগ ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের বন্য প্রাণী সহব্যবস্থাপনা কমিটির (সিএমসি) অনুমতি নিয়ে তাঁরা জাতীয় উদ্যানে পাকা ভবন নির্মাণ করছেন। এখানে রেস্তোরাঁর ব্যবসা করার জন্য তাঁরা ভবন নির্মাণ করছেন।

মাসুম বিল্লাহ বলেন, এই ভবনের পাশাপাশি একই স্থানে আরও দুটি দোকানঘর তাঁর দখলে রয়েছে। এ দুটি ঘরও তিনি বন বিভাগের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে করেছেন। কার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি তা জানাতে রাজি হননি।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এলাকার লোকজন বলছেন, ব্যবসার জন্য বনের ভেতরে একের পর এক রেস্তোরাঁ করার জন্য ঘর নির্মাণ করা হলে মানুষের আনাগোনা বাড়বে। বনের ভেতরে লোকসমাগম বাড়লে এখানকার বনের পরিবেশ নষ্ট হবে এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।

এ বিষয়ে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের বন (রেঞ্জ) কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল-আমিন বলেন, এখানে রেস্তোরাঁ ব্যবসা করার জন্য সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের সহব্যবস্থাপনা কমিটি স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। যে কারণে এখানে দোকানঘর নির্মাণ করা হচ্ছিল। এখন ইউএনওর নির্দেশে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতরে নির্মাণাধীন পাকা দোকানঘর
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতরে নির্মাণাধীন পাকা দোকানঘর

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের সহব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও দেওরগাছ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শামসুন্নাহার চৌধুরী বলেন, উদ্যানে আসা পর্যটকদের খাওয়াদাওয়া ও বিশ্রামের জন্য এ ভবনগুলো নির্মাণে অনুমোদন দেওয়া হয়। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে কমিটি সভায় বনে ঘর নির্মাণের বিষয়ে রেজল্যুশন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে বন বিভাগের কাছ থেকে এ বিষয়ে মৌখিক অনুমোদন নেওয়া হয়।

চুনারুঘাটের ইউএনও সিদ্ধার্থ ভৌমিক বুধবার জানান, তিনি বনের ভেতরে দোকানঘর নির্মাণের অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পাশাপাশি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আকাশ দেববর্মা ও মাসুম বিল্লাহকে তাঁর অফিসে ডেকে আনেন। তাঁরা এ ঘর নির্মাণের বিষয়ে বন বিভাগের কোনো লিখিত অনুমোদন দেখাতে পারেননি। এ কারণে তাঁদের বলে দেওয়া হয়েছে কাজ বন্ধ রেখে এ স্থাপনা সরিয়ে নিতে। পাশাপাশি তিনি বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তাঁকে বলেন, এ ঘর নির্মাণের বিষয়ে তাঁরা (বন বিভাগ) কোনো অনুমোদন দেননি। ইউএনও আরও জানান, এ ভূমি বন বিভাগের। তাই বন বিভাগকে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.