আমি কোন কূল হতে কোন কূলে যাব, কাহারে শুধাই রে…’—এমন আকুল করা গানের সুর এখন প্রায়ই কানে বাজে। ইউটিউবে কেউ হয়তো শুনছেন, নয়তো নিজের কণ্ঠেই বাজিয়ে নিচ্ছেন আকুলতা। শতবর্ষের পুরোনো এই গান বেশ কয়েক দিন ধরেই আবার প্রাণে পরশ বোলাচ্ছে। আর তা সম্ভব হয়েছে কোক স্টুডিও বাংলার মাধ্যমে। কোক স্টুডিও বাংলার দ্বিতীয় মৌসুমের ‘নদীর কূল’ গানে বহু বহু বছর আগের প্রাণের হাহাকারের সঙ্গে মিলে যায় একবিংশ শতাব্দীর প্রাণের হাহাকার।
‘“নদীর কূল” গানটা করতে গিয়ে মনে হলো ওপরওয়ালা ধারাবাহিকভাবে আমাদের দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। কী জাদুবলে যন্ত্রসংগীত বাজাচ্ছেন সবাই, বুকের শূন্যতায় প্রাণের ভেতর থেকে শিল্পী গেয়ে চলছেন নদীর কূলের কথা! অদ্ভুত এক মিশ্রণ এই গান। যেন সবকিছুতেই ঐশ্বরিক এক ছোঁয়া ছিল।’ এমনটাই মনে করেন এই গানের সংগীতায়োজক ও গায়ক শায়ান চৌধুরী অর্ণব।
কখন থেকে গানটি নতুন করে দর্শক-শ্রোতার সামনে তুলে ধরার ভাবনার বীজ বোনার শুরু? এমন প্রশ্নে অর্ণব বলেন, ‘আমরা তো সংগীতপ্রেমী জাতি। আমাদের পূর্বতন গানের ইতিহাস অনেক গৌরবময়। কোক স্টুডিও বাংলা এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে আমাদের গানের স্বর্ণযুগকে নতুন প্রজন্মের কাছে সুন্দর করে তুলে ধরতে চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রথম মৌসুমেই ইচ্ছা ছিল একটা ভাটিয়ালি গান করার। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। এবার দ্বিতীয় মৌসুমে আমরা পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের লেখা এবং কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া এই গানকে নতুন করে সবার সামনে আনতে পেরেছি। দর্শক-শ্রোতা যেভাবে গানটাকে ধারণ করছেন, আমরা আসলেই অনেক খুশি।’
এই গানের মূল শিল্পী রিপন কুমার সরকার, যিনি ‘বগা তালেব’ নামে বেশি পরিচিত। গানের নেপথ্যের কথা শুনতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথম মৌসুম থেকেই ভাটিয়ালি গানের একটা পরিকল্পনা ছিল। এবার বেশ কয়েকটা গান হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি কোনো গানই গাইতে পারছি না। খুব মন খারাপ হচ্ছিল। আমি তো বারবার অর্ণবদাকে বলতাম, আমি তাইলে বাদ…(হাসি)। এরপর এই গান নিয়ে কাজ করা। আর এর পরের গল্পটা তো প্রায় সবারই জানা।’
গানের শুটিংয়ের সময় মজার কোনো অভিজ্ঞতা?
প্রশ্নটা শুনেই রিপন কুমার সরকার উচ্চ স্বরে কতক্ষণ হেসে নিলেন। ‘আসলে গানের সময় অর্ণবদা আমাদের কোনো মতামত চাপিয়ে দেন না। আমরা যেমনটা চাই, তিনি পুরোপুরি স্বাধীনতা দেন। তো গানের শুটিংয়ের সময় আমার চুলগুলো নিয়ে আমি খুব দ্বিধায় ছিলাম। খুলে রাখব না বেঁধে রাখব?
অর্ণবদা বললেন, তোর যা ইচ্ছা কর। এ কথার ভরসায় বেশ কয়েকবার চুল বেঁধে, কয়েকবার চুল ছেড়ে রেখে গানের শুটিং করি। শেষ পর্যন্ত যখন বললাম, না, চুল বেঁধে রাখলে আমাকে তেমন ভালো দেখাচ্ছে না, তখন তিনি হেসে আমার খোলা চুলের পাগলামিকেই সায় দিলেন। এত সুন্দর একটা দল, মনেই হয়নি কাজ করছি। আড্ডাচ্ছলে আমরা গানটা তুলেছি।’
কোক স্টুডিও বাংলার গানগুলোয় সব সময় থাকে আনন্দচ্ছটা। রঙের খেলা। সেই অনুযায়ী ঝলমলে রঙিন পুরো সেট সাজানো। কিন্তু এবার তো ছিল নদীর গান। শূন্যতার গান। হাহাকারের ডাক। তো, এবার কীভাবে সাজানোর পরিকল্পনা ছিল এ গানের সেট?
এ বিষয়ে ‘নদীর কূল’-এর ভিডিও পরিচালক কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘এত দিন তো আমরা খুব রঙিন, লালচে ধারা অনুসরণ করেছি। এবার চেষ্টা ছিল শূন্যতা সৃষ্টি নিয়ে। নদীর রং দিয়েছি সায়ান ব্লু, এটা একধরনের হাহাকারের রেশ দেয়। আমরা আগের গানগুলোয় প্রচুর প্রপস ব্যবহার করেছি, কিন্তু এই গানের ভিত্তিই ছিল যত কমে করা যায়। এর মধ্যে নদীর পানির শব্দ, বাঁশি, কীর্তন, খোলের মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতা তাদের গ্রামবাংলাকে পুরোটাই খুঁজে পাবেন।’