গবেষণার তথ্য বলছে, দেশে ৩১ বছরে যশোর সর্বোচ্চ ৯২৭ দিন তপ্ত ছিল। এর পরেই আছে চুয়াডাঙ্গা, ৯০০ দিন। এই সময়ে চট্টগ্রাম মাত্র ৯ দিন তপ্ত ছিল।
চলতি জুন মাসের প্রথম সাত দিনের প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো স্থানে বয়ে গেছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এই সাত দিনের মধ্যে তিন দিন তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে যশোরে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ৩১ বছরে দিনের হিসাবে সবচেয়ে বেশি দিন তপ্ত ছিল যশোর। তপ্ত দিনগুলোয় যশোরে তাপমাত্রা কখনোই ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামেনি।
একই গবেষণার তথ্য বলছে, যশোরের পর তপ্ত দিন গেছে চুয়াডাঙ্গা ও রাজশাহীতে। এর পরে রয়েছে পাবনা ও সাতক্ষীরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক তাপপ্রবাহের অবস্থা নিয়ে ‘বাংলাদেশে সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহের প্রবণতা’ শীর্ষক ওই গবেষণা করেছেন। আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশের ৪৪টি স্টেশনের আবহাওয়া পরিস্থিতি তুলে ধরে। গবেষণায় এসব স্টেশনের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণায় ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৩১ বছরের তাপপ্রবাহের উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের সংজ্ঞা অনুযায়ী, তাপমাত্রা যদি ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়, তাহলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলে। ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বলা হয়। তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয় যখন তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। আর অতি তীব্র হয় ৪২ ডিগ্রি বা তার বেশি হলে।
আবুল কালাম মল্লিক বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের দক্ষিণ–পশ্চিমের যশোর ও চুয়াডাঙ্গা এবং উত্তর–পশ্চিমের রাজশাহী অঞ্চলে তপ্ত দিনের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি। বছরে বেশি দিন তপ্ত থাকে এসব অঞ্চল।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ৩১ বছরে যশোরে সর্বোচ্চ ৯২৭ দিন উত্তপ্ত ছিল। এর পরেই আছে চুয়াডাঙ্গা, ৯০০ দিন। তৃতীয় সর্বোচ্চ তপ্ত দিন গেছে রাজশাহীতে, ৮৮৬ দিন। উত্তরের আরেক জনপদ পাবনার ঈশ্বরদীতে তপ্ত দিনের সংখ্যা ছিল ৭৮০। সাতক্ষীরায় ৫২৬ দিন। আর রাজধানী ঢাকায় তপ্ত দিনের সংখ্যা ছিল ২৫৫।
মার্চ থেকে মে—এই তিন মাস দেশে প্রাক্–মৌসুমি বায়ুর সময়। দেশের সবচেয়ে উষ্ণ মাস হলো এপ্রিল ও মে মাস। এ গবেষণায় এই প্রাক্–মৌসুমি বায়ুর সময়ের তাপপ্রবাহের সময়টাই দেখা হয়েছে।
আহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে জুনের প্রথম ছয় দিন দেশের কোথাও না কোথাও তীব্র তাপ্রবাহ ছিল, যা ৪৪ বছরের মধ্যে রেকর্ড। এর আগে ১৯৭৯ সালে সর্বোচ্চ জুনের প্রথম পাঁচ দিন তীব্র তাপপ্রবাহ ছিল।
যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও রাজশাহীতে এত গরম কেন
যশোর ও চুয়াডাঙ্গা কাছাকাছি এলাকা। এর বেশ খানিকটা দূরে রাজশাহী। তবে এসব অঞ্চলের তাপের কারণটা উপমহাদেশীয় তাপপ্রবাহ বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব বিভাগের অধ্যাপক কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ। তিনি গতকাল শুক্রবার বলেন, ভারতের মরু অঞ্চল রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে তাপপ্রবাহ বাংলাদেশে প্রবেশ করে যশোর ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চল দিয়ে। ফলে উচ্চ তাপমাত্রার বাতাস বাংলাদেশের পশ্চিম দিক থেকে প্রবেশ করে দেশের পশ্চিমাঞ্চল বেশি উত্তপ্ত করে তোলে এবং এ অঞ্চলে বেশি দিন তাপপ্রবাহ থেকে যায়।
কিন্তু রাজশাহীতে এত তাপ কেন? অধ্যাপক মতিন উদ্দিনের ভাষ্য, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল প্রকৃতিগতভাবেই রুক্ষ। উপগ্রহের পুরোনো চিত্রগুলোয় দেখা যায়, এই অঞ্চলে জলাভূমি অনেক কম। যদিও এখন সেই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তবে জলাভূমি কম থাকা এখানে অতি তাপের একটি কারণ।
চুয়াডাঙ্গা, ঈশ্বরদী, যশোর ও রাজশাহী—এই অঞ্চল দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহের একটি অঞ্চল বলে মত দেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার। তাঁর মতে, এসব এলাকার বৈশিষ্ট্য অভিন্ন।
সবচেয়ে কম তাপ চট্টগ্রামে
আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিকের বিশ্লেষণে দেখা যায়, গবেষণার ৩১ বছরে চট্টগ্রাম মাত্র ৯ দিন উত্তপ্ত ছিল। এটি বাংলাদেশে সবচেয়ে কম তাপের এলাকা।
দক্ষিণ–পূর্বের এ জনপদে তাপ কম কেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মতিন উদ্দিন এর একটি ব্যাখ্যা দেন। তাঁর মতে, চট্টগ্রাম সমুদ্রপারের অঞ্চল। এখানে দক্ষিণের হাওয়াটা বেশি থাকে। তাই পশ্চিমের এ গরম হাওয়া দেশের পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর–পশ্চিম অঞ্চলকে উত্তপ্ত করলেও চট্টগ্রামের দিকে পৌঁছাতে পারে না। আরেকটি কারণ, চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল। এসব গরম হাওয়া আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যে বাংলাদেশে তপ্ত দিনের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ‘ক্লাইমেট রিস্ক কান্ট্রি প্রোফাইলে’ তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বলা হয়েছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার দিন বেশি দেখা যাচ্ছে।