খালি মাঠেও গোলপোস্ট খুঁজছেন নৌকার প্রার্থী

0
138
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে খালি মাঠে সহজে গোল দেবে আওয়ামী লীগ।

বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় ধারণা করা হচ্ছিল, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে খালি মাঠে সহজে গোল দেবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু প্রচার শুরুর পর নির্বাচনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রচারে চরমোনাই পীরের হাতপাখা টক্কর দিচ্ছে আওয়ামী লীগের নৌকাকে। জাতীয় পার্টিও (জাপা) সর্বশক্তি নিয়ে আছে মাঠে। ভোটের অঙ্ককে আরও জটিল করেছে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হওয়া প্রার্থীর টেবিলঘড়ি। বিএনপি সমর্থকদের ভোট হাতপাখা, লাঙ্গল ও ঘড়ির মধ্যে কীভাবে ভাগ হবে, তার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে নৌকাকে।

তবে নৌকার বিপদ অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগের গৃহবিবাদ। ক্ষমতাসীন দলেরই মনোনয়নবঞ্চিত অংশ হাতপাখায় বাতাস দিচ্ছে বলে ভোটের মাঠের খবর। ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত নেতারা জানিয়েছেন, বিএনপির ভোট যেন হাতপাখার দিকে না যায়, সেজন্য নির্বাচনে রাখা হয়েছে ঘড়িকে। কিন্তু তাতেও বিপদ পুরোপুরি কাটেনি। আওয়ামী লীগের সব ভোট নৌকায় তুলতে না পারলে গাজীপুরের মতো বিপদের শঙ্কা রয়েছে বরিশালেও।

আশা জাগিয়েছে গাজীপুর, উৎসবমুখর প্রচার

আগামী সোমবার বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট। আজ শনিবার শেষ হচ্ছে প্রচার। গত ২৫ মে অনুষ্ঠিত গাজীপুরের সুষ্ঠু নির্বাচন বরিশালের ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে উৎসাহ বাড়িয়েছে। নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার আশায় উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

গতকাল শুক্রবার বরিশাল শহরের প্রধান সড়ক এবং অলিগলি ঘুরে দেখা গেল, অন্তত পোস্টার-ব্যানারের সংখ্যায় সাত মেয়র প্রার্থীর চারজন প্রায় সমানে সমান। ২০১৮ সালের একতরফা নির্বাচনে প্রচারে একচেটিয়া এগিয়ে ছিল নৌকা। সেবার বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও ধানের শীষের ব্যানার-পোস্টার ছিল হাতেগোনা। আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য মেয়র প্রার্থীরাও প্রতিবন্ধকতায় পড়েছিলেন।

শুধু বিএনপি নয়, জামায়াত নেতাদের প্রচারও নির্বিঘ্ন 

এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। খোকন সেরনিয়াবাত নামে পরিচিত আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ নৌকার পোস্টার, ব্যানার, মিছিল সংখ্যায় বেশি হলেও গত নির্বাচনের মতো একচ্ছত্র আধিপত্য নেই আওয়ামী লীগের। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের হাতপাখা প্রতীকের পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে গেছে বরিশাল। মিনিটে মিনিটে বাজছে হাতপাখার মাইক।

বিএনপির সাবেক মেয়র আহসান হাবীব কামালের ছেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রূপনের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীরা না থাকলেও ঘড়ির প্রচারও কম নয়। হাতেগোনা কয়েকজন সমর্থককে নিয়ে ঘরে ঘরে যাচ্ছেন তিনি। ঘড়ির চেয়ে প্রচারে এগিয়ে জাপার ইকবাল হোসেন তাপসের লাঙ্গল।

প্রচারে কাউন্সিলর প্রার্থীরা এগিয়ে

প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা প্রার্থী হয়েছেন। প্রচারে তাঁদের চেয়ে পিছিয়ে নেই কাউন্সিলর পদের লড়াইয়ে নামা বিএনপি নেতারা। আওয়ামী লীগ নেতাদের সমর্থকদের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষ হলেও বিএনপির কেউ এবার আক্রান্ত হননি। অথচ গতবার মাঠে নামতেই পারেননি। কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হওয়া জামায়াত নেতারাও এবার নির্বিঘ্নে প্রচার চালাচ্ছেন।

ধানের শীষের ভোট নৌকা পাবে কি

প্রথম তিন নির্বাচনের ভোটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বরিশাল সিটি করপোরেশন বিএনপি অধ্যুষিত। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট লস্কর নূরুল হকও তা মানছেন। তিনি বলেছেন, পুরোনো পৌর এলাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমানে সমান হলেও বর্ধিত এলাকায় এগিয়ে ধানের শীষ। তাঁর অনুমান, বিএনপির ভোট ঘড়ি, হাতপাখা ও লাঙ্গলে ভাগ হবে। এতে নৌকার জয় নিশ্চিত।

বরিশালের সাবেক মেয়র মজিবর রহমান বলেছেন, বিএনপির অনুগত কর্মীরা ভোট দিতে যাবে না। আর যারা যাবে, তারা যেখানেই হোক নৌকায় ভোট দেবে না। যারা ইসলামের কথা পছন্দ করে, তারা হাতপাখায় দিতে পারে। গণতন্ত্রের কথা শুনে কেউ কেউ লাঙ্গলে দিতে পারে। কিন্তু ঘড়িতে দেওয়ার কথা নয়।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দু’দলের নেতারাই বলছেন, ভোটের হার যত কমবে, তত লাভ আওয়ামী লীগের। ধানের সমর্থকরা ভোট দিতে না গেলে, হাতপাখা, ঘড়ি ও লাঙ্গলের ভোট কমবে। কিন্তু ভোটের হার বাড়লে বিপদ বাড়বে নৌকার। তপশিল ঘোষণার পর কামরুল আহসান রূপনকে দুদক ডেকেছিল। তিনি যেন নির্বাচনের মাঠে থাকেন, সে জন্য দুদকের ইস্যুতে তাঁকে সহায়তা করেছে ক্ষমতাসীন দল।

আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, ভোট ছাড়া জয়ের সুযোগ নেই। প্রশাসন স্পষ্ট করে জানিয়েছে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। গাজীপুরের মতোই ভোটকেন্দ্রে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকবে না। যদিও হাতপাখার প্রার্থী অভিযোগ করেছেন, সরকারি সংস্থা কাজ করছে নৌকার পক্ষে।

ধানের শীষের ভোট ধরতে নরম আওয়ামী লীগ

বরিশালে ভোটের প্রচারে বিএনপির সম্পর্কে নীরব রয়েছে আওয়ামী লীগ। চলমান জাতীয় রাজনীতির নানা ইস্যুতে দলটির নেতারা সারাদেশে বিএনপির সমালোচনায় মুখর থাকলেও ধানের শীষের ভোট পেতে বরিশালে ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। নৌকার প্রার্থী বিএনপির বিরুদ্ধে একটি শব্দও বলেননি। বরং নিজ দলের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর সমালোচনায় মুখর রয়েছেন। তিনি দায়িত্ব পালনকালে কী কী অনিয়ম হয়েছে, বরিশালের নাগরিকরা কীভাবে অপদস্থ হয়েছেন, তার ফিরিস্তি তুলে নগরবাসীকে সম্মান দেওয়ার কথা বলছেন।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপির ভোট যেন একজোট হয়ে নৌকার বিরুদ্ধে না যায়, সে জন্যই এই কৌশল। তবে তাঁরা এটাও বলছেন, গত কয়েক বছরে জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ধানের শীষের সমর্থকদের ভোট নৌকায় আনা প্রায় অসম্ভব।

কোথায় যাবে বিএনপির ভোট

গতকাল শুক্রবার চকবাজারের মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করে গণসংযোগ করেন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী। বিএনপি কার্যালয়-সংলগ্ন এলাকায় জড়ো হওয়া দলটির কর্মীদের হাতপাখার লিফলেট দেন। তিনি চলে যাওয়ার পর বিএনপির এক কর্মী বললেন, ‘এবার হাতপাখা।’ সড়কের অপর পাশ থেকে আরেক কর্মী বললেন, ‘ঘড়ি, এবার ঘড়ি।’ হাতপাখার পক্ষে বলা কর্মীটি বললেন, ‘ঘড়ি মির্জা জাফর।’ এই দুই কর্মীর মতো বরিশালের নির্বাচনে নানাভাগে ভাগ হয়ে গেছে নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি।

বিএনপি শুধু নির্বাচন বর্জনই নয়, কর্মী-সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে না যেতে কড়া নির্দেশ দিয়েছে। ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত না মেনে কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়া দলের ১৮ নেতাকে বহিষ্কার করেছে। তবে বিএনপি সূত্র বলছে, দলীয় নেতারা কাউন্সিলর ভোটে থাকায় তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়া ঠেকানো যাবে না।

হাতপাখার ফয়জুল করীম প্রার্থী হওয়ার দিন থেকেই বলছেন, বিএনপির ভোট তিনি পাবেন। তবে ঘড়ি প্রতীকের মেয়র প্রার্থী কামরুল আহসান রূপন বলেছেন, দল বহিষ্কার করলেও তিনি মনপ্রাণে বিএনপি। নির্বাচনে জিতে বিএনপিতেই ফিরবেন।

গতকাল নগরীর নাজিরাপুল এলাকায় ভোটের প্রচার চালানোর ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় রূপনের সঙ্গে। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন মাত্র আটজন সমর্থক। বিএনপির কাউকে তাঁর পাশে দেখা যায়নি। নিজেকে জাতীয়তাবাদী প্রার্থী আখ্যা দিয়ে রূপনের দাবি, ধানের শীষের সব ভোট ঘড়িতে আসবে। তাঁর ভাষ্য, ভোটাররা জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের ‘বি টিম’ এবং ইসলামী আন্দোলকে ‘সি টিম’ হিসেবে বিবেচনা করে।

বরিশাল বিএনপির জ্যেষ্ঠ কোনো নেতার সঙ্গে যোগাযোগ নেই বলে জানিয়ে তিনি বলেন, নেতারা কী বলছেন গুরুত্বপূর্ণ নয়। নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা ভোট দেবেন ঘড়িতে।

আওয়ামী লীগের সব ভোট নৌকায় উঠবে কি

সাদিক আবদুল্লাহকে বাদ দিয়ে তাঁরই চাচা খোকন সেরনিয়াবাতকে প্রার্থী করেছে আওয়ামী লীগ। গত ৪ এপ্রিল থেকে বরিশালে নেই সাদিক। তাঁর বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ দু’বার এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর দুই ভাগনে এবং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের দুই ছেলে আবুল হাসানাত এবং খোকন সেরনিয়াবাত প্রকাশ্যে কোলাকুলি করলেও তৃণমূলে আওয়ামী লীগের বিরোধ দূর হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতারা নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, নৌকাকে হারাতে কাজ করছেন সাদিকপন্থিরা। হাসানাত পরিবারের অনুসারী কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকরা নৌকায় ভোট দেবেন কিনা, নিশ্চিত নয়। ধানের শীষ ভোটে না থাকায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও ভোট দিতে পারেন। যেমনটা হয়েছে গাজীপুরে। আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খানকে ভোট না দিয়ে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনকে সমর্থন দিয়েছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী।

গাজীপুরের মতো বরিশালে আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ প্রকাশ্যে নৌকার বিরোধিতা না করলেও ক্ষমতাসীন দলের সব ভোট নৌকায় আসবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। যদিও লস্কর নূরুল হক বলেছেন, খোকন সেরনিয়াবাত অল্প সময়েই ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। আর যারা বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগকে ভালোবাসে তারা কোনো অবস্থাতেই নৌকার বিরুদ্ধে ভোট দেবে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.