২০১৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ‘গোল্ডেন ভিসা’ পদ্ধতি চালু করে। কেউ ২০ লাখ দিরহাম (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৬ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করলে বা আমিরাতের কোনো ব্যাংকে জমা রাখলে তাঁকে ১০ বছরের জন্য কোনো প্রশ্ন ছাড়া আমিরাতে অবাধে প্রবেশের ভিসা প্রদানের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
এই গোল্ডেন ভিসার সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমানসংখ্যক ব্যবসায়ী তিন বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার পাশাপাশি দুবাইয়ে পুঁজি পাচারকে আকর্ষণীয় বিষয় হিসেবে বেছে নিতে শুরু করেছেন।
পরিবারের সদস্যদের বসবাসের গন্তব্য হিসেবে দুবাই এখনো ওই দেশগুলোর মতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি, কিন্তু ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ থেকে যেহেতু বেশি দূরে নয়, তাই দেশ হিসেবে আমিরাতের নানাবিধ সুবিধা ব্যবসায়ীদের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এমনকি পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশে রেখে এবং মাঝেমধ্যে আমিরাতে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার সুবিধা ভোগ করে এসব ব্যবসায়ী আমিরাতে এবং বিশেষত দুবাইয়ে বিনিয়োগকে বেশি মুনাফাদায়ক ও আকর্ষণীয় বিবেচনা করছেন।
মনে রাখতে হবে, সৌদি আরবের পর সংখ্যার দিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশি অভিবাসীদের দ্বিতীয় প্রধান গন্তব্য। এর ফলে দেশে প্রবাসী আয় পাঠানো বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মীদের জন্য হুন্ডি ব্যবসায়ীরা আমিরাতে অত্যন্ত সক্রিয়, আমিরাত থেকে বাংলাদেশে পাঠানো প্রবাসী আয়ের সিংহভাগ হুন্ডি ব্যবসায়ীরাই দখলে নিয়ে নিয়েছেন বহুদিন যাবৎ। এখন যখন আমিরাত ‘গোল্ডেন ভিসা’ চালু করেছে, তাই অন্যান্য দেশে পুঁজি পাচারের পাশাপাশি খোদ আমিরাতে এবং বিশেষত দুবাইয়ে পুঁজি পাচারে প্রচণ্ড গতি সঞ্চারিত হয়েছে গত সাড়ে তিন বছরে।
এ পর্যায়ে উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে আমিরাত থেকে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক পথে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো প্রবাসী আয়কে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এ তথ্য বিভ্রান্তিকর হতে পারে। কারণ, সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে যে ক্রমবর্ধমান হারে অবৈধ পুঁজি পাচার হয়ে চলেছে, সে বিষয়কে আড়াল করে দিতে পারে সাম্প্রতিক এই প্রবাসী আয়ের প্রবাহের চিত্র। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা প্রয়োজন, হুন্ডিওয়ালাদের অনেকেরই আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক রয়েছে।
তাই বিশ্বের যেসব দেশ বাংলাদেশি অভিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য হিসেবে ভূমিকা পালন করছে, সেসব দেশের বাংলাদেশি প্রবাসীদের কাছ থেকে হুন্ডিওয়ালারা ডলার কিনে সেগুলো বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে পুঁজি পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করতে পারে। অতএব এটা মনে করা উচিত নয় যে আমিরাত থেকে আনুষ্ঠানিক পথে পাঠানো প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বেড়ে গেলে তা বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে পুঁজি পাচার কমিয়ে দেবে।
কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রায় অর্ধেক প্রবাসী আয় এখন হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশে আসছে। আমার ধারণা, বিভিন্ন সুবিধার কারণে বাংলাদেশের সিংহভাগ প্রবাসী আয় প্রেরক হুন্ডি পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। অতএব ২১ বিলিয়ন ডলার যদি আনুষ্ঠানিক পথে দেশে প্রবাসী আয় আসে, তাহলে কমপক্ষে আরও ২১ থেকে ২২ বিলিয়ন ডলার বা তার চেয়েও বেশি প্রবাসী আয় (টাকার আকারে) হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশের অর্থনীতিতে ঢুকছে। এর মানে, দেশে পাঠাতে গিয়ে এই বৈদেশিক মুদ্রাগুলো (প্রধানত ডলার) বিদেশের হুন্ডিওয়ালাদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এর কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত দামের চেয়ে তাঁরা ডলারের বেশি দাম পাচ্ছেন। তা ছাড়া এই পদ্ধতিতে অতি দ্রুত কোনো ঝুটঝামেলা ছাড়া অর্থ পাঠানো যায়।
আরও যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের বাইরের কেউ জানতেও পারে না যে পরিবারে প্রবাসী আয় এসেছে। টেলিফোনে খবর পেয়ে যথাস্থানে গিয়ে বা নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা পেয়েই প্রবাসী আয় গ্রহীতারা দ্রুত তা নিকটবর্তী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে আমানত হিসেবে জমা করে দেন।
এতে চোর-ডাকাত-মাস্তানদের হুমকি থেকে অনেকটাই নিরাপদ থাকে পরিবারগুলো। যেহেতু বিশ্বস্ততাই হুন্ডি ব্যবসার সাফল্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তাই প্রবাসী আয়ের টাকা মার যায় না এবং লেনদেনের গোপনীয়তাও রক্ষা করা হয় সযতনে। ফলে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেল কোনোভাবেই হুন্ডির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না।
কিন্তু হুন্ডির মাধ্যমে ডলারের সমপরিমাণ টাকা যেহেতু প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যরা পেয়ে যাচ্ছেন, তাই এই অর্থ প্রবাসীদের পরিবার ও স্বজনদের ভোগ ও বিনিয়োগে ব্যাপক অবদান রাখছে। আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক যেভাবেই আসুক, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে এবং এর বহুবিধ সুফল পাওয়া যাচ্ছে। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ সত্ত্বেও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো যে বড়সড় সংকটে পড়ছে না, তার পেছনে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে কিংবা হুন্ডি পদ্ধতিতে পাঠানো প্রবাসী আয়ের বিশাল আমানতের প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এক অর্থে এই বিপুল প্রবাসী আয়ের অর্থ বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের একটা তাৎপর্যপূর্ণ বিকল্পের ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের চমকপ্রদ উল্লম্ফনও ঘটাচ্ছে ক্রমবর্ধমান প্রবাসী আয়। অনেক দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ‘প্যারাডক্স’ বা বিভ্রম আখ্যায়িত করে থাকেন। এত দুর্নীতি সত্ত্বেও দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকে তাঁদের কাছে আপাতদৃষ্টে স্ববিরোধী মনে হয়।
আমার মতে, এই বিপুল প্রবাসী আয়প্রবাহের ইতিবাচক দিকটি তাদের বিবেচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে বলেই তঁারা একে বিভ্রম হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু যে ‘হুন্ডি ডলার’ বিদেশেই রয়ে যাচ্ছে, সেগুলো প্রধানত কিনছে পুঁজি পাচারকারীরা। মার্জিনখোর রাজনীতিক, দুর্নীতিবাজ আমলা-প্রকৌশলী, রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি বা ডাকসাইটে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি বলুন—হুন্ডি ডলারের সহায়তায় বিদেশে ক্রমে গড়ে উঠছে তাঁদের ঘরবাড়ি, ব্যবসাপাতি, টরন্টোর বেগমপাড়া কিংবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমগুলো।
সাম্প্রতিক কালে দুবাইয়ে অফিস খোলার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তা আসলে ব্যবসায়ীদের পুঁজি পাচারের এক নতুন মাত্রা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। যেখানে আমলা, রাজনীতিবিদ কিংবা তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের চেয়েও মাঝারি পুঁজিপতি ব্যবসায়ীরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে দুবাই এখন সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের চেয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাছে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সেই বিবেচনা থেকেই আমি মনে করছি, দুবাই ক্রমেই বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য পুঁজি পাচারের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। যথাযথ গুরুত্বসহ দুবাইয়ে অবৈধ পুঁজি পাচারের বিষয়টি দমনের প্রয়াস নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি।
যেহেতু এমন পুঁজি পাচারকারীরা ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার করার জন্য হুন্ডি ব্যবস্থাকে ব্যবহার করছেন, তাই হুন্ডি ডলারের দাম বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গত ১৮ জুন ঘোষিত মুদ্রানীতি অনুযায়ী বাজারের নিয়মে নির্ধারিত দামের চেয়ে ৭ থেকে ৮ টাকা বেশি থেকেই যাবে। হুন্ডি ডলারের চাহিদাকাঠামো শক্তিশালী থাকলে হুন্ডি ব্যবসাকে কঠোরভাবে দমনের ব্যবস্থা না নিলে বাজারে ডলারের একক দাম প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
হুন্ডি পদ্ধতিতে পুঁজি পাচার দমনে সরকার সত্যিকারভাবে আন্তরিক হলে নিচের পদক্ষেপগুলো অপরিহার্য মনে করি। প্রথমত, অবিলম্বে দেশের এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো কিছুদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হোক। বেশির ভাগ এক্সচেঞ্জ হাউস হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে আমাদের কাছে খবর রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, দুবাইয়ে তদন্ত টিম পাঠিয়ে এসব ব্যবসায়ীর সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহ করে পুঁজি পাচারকারীদের ব্যাংকের ঋণ গ্রহণে অযোগ্য ঘোষণা করা হোক। তৃতীয়ত, দেশের শহরগুলোয় কিংবা গ্রামে, যেখানেই প্রবাসীদের পরিবার পাকা বাড়ি নির্মাণ করবে, তাদের বাড়ির নির্মাণ ব্যয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে দেশে আনার ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ ব্যাংক স্টেটমেন্ট’ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে গৃহনির্মাণের পূর্বানুমতির জন্য জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা চালু করা হোক।
- ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক