কক্সবাজারে টানা কয়েক দিন ধরে দাবদাহ চলছে। তীব্র গরমে বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হলেও সুবাতাস বইছে লবণ চাষে। জেলার ৬০ হাজার একরের বেশি মাঠে দৈনিক রেকর্ড ৩৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হচ্ছে। এতে মহাখুশি উপকূলের ৪৫ হাজারের বেশি প্রান্তিক লবণচাষি।
চাষিরা বলছেন, আগামী ২০-২৫ দিন এমন অবস্থা বিরাজ করলে ৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ (দৈনিক ৩৫ হাজার টন ধরে) উৎপাদন সম্ভব হবে। চলতি মৌসুমে আগের চার মাসে উৎপাদন হয়েছে আরও ১৬ লাখ মেট্রিক টন। সব মিলিয়ে দেশের ২৪ লাখ মেট্রিক টন লবণের বার্ষিক চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে। অবশ্য এর মধ্যে কালবৈশাখীর তাণ্ডব কিংবা ঝড়-বৃষ্টি হলে লবণ উৎপাদন ব্যাহত হবে। এক দিন বৃষ্টি হলে প্রায় এক সপ্তাহ লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকে। তখন ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হবে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যানুযায়ী, চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ৫ মাস) কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, রামু ও বাঁশখালী উপজেলার ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। এসব জমিতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন।
গতকাল শুক্রবার কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল, চৌফলদণ্ডী, পিএমখালী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কয়েক হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন চলছে। চাষিরা মাঠের ওপর কালো ত্রিপল বিছিয়ে সমুদ্রের লোনাপানি জমিয়ে রাখছেন। তপ্ত রোদে শুকিয়ে সেই লোনাপানি লবণে পরিণত হচ্ছে। কিছু চাষি মাঠে উৎপাদিত লবণ গর্তে ঢুকিয়ে (মজুত) রাখছেন। কেউ কেউ বস্তায় ভরে লবণ বাড়ির আঙিনায় স্তূপ করে রাখছেন। কেউ গুদামে মজুত করছেন।
বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, গত মৌসুমে এ সময়ে দৈনিক সর্বোচ্চ ৩০ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছিল। এবার তীব্র দাবদাহের ফলে টানা তিন দিন ধরে দৈনিক ৩৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হচ্ছে, যা মৌসুমের সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদন।
গত দুই দিনে টেকনাফ, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর উপজেলার বিভিন্ন উপকূল ঘোরার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে মো. ইদ্রিস আলী বলেন, মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪১০ থেকে ৪২০ টাকায়। গড়ে ৪০০ টাকা ধরলে দৈনিক উৎপাদিত ৩৫ হাজার মেট্রিক টন লবণের দাম আসে ৩৫ কোটি টাকা। আগামী ১৫ মে পর্যন্ত লবণ উৎপাদনের মৌসুম উল্লেখ করে ইদ্রিস আলী বলেন, প্রতিবছর এপ্রিলের মাঝামাঝিতে কালবৈশাখী, বৃষ্টি দেখা দেয়। এতে সাত-আট দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকে। এবারও তেমন পরিস্থিতি বিরাজ করলে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২ এপ্রিলের ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টিতে টানা সাত দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ ছিল। ১০ এপ্রিল থেকে পুরোদমে লবণ উৎপাদন শুরু হয়। এর আগে ২০ মার্চের ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টিতে সাত দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ ছিল।
কক্সবাজার সদরের পিএমখালীর চাষি বেদারুল আলম (৫৫) বলেন, কয়েক দিন ধরে মাঠে লবণের বাম্পার উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু এতেও মনে শান্তি নেই। কারণ, আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে একাধিক নিম্নচাপ ও একটি ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। তখন লবণ চাষের মারাত্মক ক্ষতি হবে।
উৎপাদন বাড়লেও লবণের দাম নিয়ে হতাশার কথা শোনা গেল চাষিদের মুখে। খুরুশকুলের চাষি গফুর আলম (৪৫) বলেন, ঝড়-বৃষ্টি হলে লবণ উৎপাদনের খরচ বাড়ে। কিন্তু সে হিসাবে লবণের দাম বাড়ে না। বর্তমানে মাঠে উৎপাদিত প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪১০-৪২০ টকায়। মণপ্রতি লবণ উৎপাদন, শ্রমিক ও পরিবহনের বিপরীতে খরচ যায় ২৮০ টাকার বেশি।
বাংলাদেশ লবণ চাষি সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি ও মহেশখালীর লবণচাষি আনোয়ার পাশা চৌধুরী জানান, সিন্ডিকেট করে লবণের দাম একেক সময় একেক রকম নির্ধারণ করা হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে চাষিরা প্রতি মণ লবণ বিক্রি করেন ২৫০-৩০০ টাকায়, মার্চে ৩২০-৩৭০ টাকায়, আর এখন ৪১০-৪২০ টাকা। চাষিদের দাবি ছিল, মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণের দাম ৫০০ টাকা নির্ধারণ।
কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক লবণ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লবণ আমদানি বন্ধ রেখে মাঠপর্যায়ে চাষিদের সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় লবণ বেচাবিক্রির সুযোগ করে দিয়েছিলেন। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ৫০০ টাকায় লবণ বেচাবিক্রিও হয়েছিল। পরবর্তীকালে সিন্ডিকেট চক্র দাম সর্বনিম্ন ২৫০ টাকায় কমিয়ে আনে।