ঢাকায় পড়তে আসা মেডিকেলছাত্রীর মৃত্যু, মায়ের চোখের জল ‘শুকাচ্ছে না’

0
124
চিকিৎসক হয়ে ওঠা হল না দীপান্বিতা বিশ্বাসের, ডেঙ্গুতে প্রাণ হারালেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের এই ছাত্রী, ছবি: সংগৃহীত

পড়াশোনার জন্য একবার বাড়ি ছাড়লে মরার আগে আর কখনোই স্থায়ীভাবে বাড়ি ফেরা হয় না- ২০ আগস্ট ফেসবুকে এই পোস্ট দিয়েছিলেন দীপান্বিতা বিশ্বাস। এরপর এক মাস না যেতেই দীপান্বিতা স্থায়ীভাবে বাড়ি ফিরেছেন, তবে লাশ হয়ে। ডেঙ্গুতে মারা গেছেন তিনি। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন দীপান্বিতা। তিনি ছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের (মিটফোর্ড হাসপাতাল) এমবিবিএস প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর দীপান্বিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর আগে তিনি মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

দীপান্বিতার বাবা অমল কৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে রোববার রাতে মোবাইলে কথা হয়। জানালেন, এডিস মশার কাছে তাঁরা হেরে গেছেন। বললেন, ‘আমি চিকিৎসকের বাবা এই ডাক শুনে মরতে চেয়েছিলাম। মেয়েটা চিকিৎসক হওয়ার আগে নিজেই মরে গেল। আমরা এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না আমাদের মেয়েটা নেই।’

অমল কৃষ্ণ বিশ্বাস বললেন, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে মেয়ের পরীক্ষা ছিল। তাই সময় দিতে পারবে না বলে পরীক্ষার পরে তাঁদের ঢাকায় যেতে বলেছিল। কিন্তু মেয়ে তো আর বাবা–মাকে সময় দিল না। তিনি জানান, দীপান্বিতার মা দীপ্তি বিশ্বাস আইসিইউতে ঢুকে মেয়েকে দেখতে চাননি। তিনি সুস্থ ও জীবিত মেয়ের মুখ দেখবেন এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু সেই মাকেই মেয়ের লাশ দেখতে হল।

অমল কৃষ্ণ বিশ্বাস খুলনায় থাকেন। তিনি পাওয়ারগ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী প্রকৌশলী। জানালেন, রাজবাড়ীর পাংশা থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে মেয়েকে দাহ করেছেন। একমাত্র ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার এবং একমাত্র মেয়েকে চিকিৎসক বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন অমল কৃষ্ণ বিশ্বাস। এই বাবা বললেন, ‘আমার নিজের পরিবার এবং শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই উচ্চশিক্ষিত, অনেক বড় বড় পদে তাঁরা চাকরি করছেন। কিন্তু আমার মেয়েটা চিকিৎসক হলে সেই হতো আমাদের দুই পরিবারের প্রথম চিকিৎসক।’

গত ৮ সেপ্টেম্বর দীপান্বিতার জ্বর আসে। মেয়ে নিজেই ফোন করে বাবা–মাকে জ্বরের কথা জানিয়েছিলেন। পরদিনই বাবা–মা ঢাকায় আসেন। মেয়ের রক্তের পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। মিটফোর্ডের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে জ্বরের জন্য নাপাসহ কিছু ওষুধ দেন চিকিৎসক। খুলনায় মেয়েকে নিয়ে যাবেন কি না তা নিয়ে চিন্তা করছিলেন অমল কৃষ্ণ বিশ্বাস। তবে এর মধ্যেই মেয়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত মিটফোর্ড হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা চলে তাঁর।

অমল কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, মেয়ে মেডিকেলের শিক্ষার্থী, দুই হাসপাতালেই চিকিৎসকেরা চিকিৎসায় কোনো গাফিলতি করেননি। আন্তরিকতার কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু মেয়ের ডেঙ্গুর ধরনটাই নাকি খারাপ ছিল। এই বাবা বললেন, ‘চিকিৎসকেরা যখন যে টেস্ট বা ওষুধের কথা বলেছেন তাতে আমরা কোনো কার্পণ্য করিনি। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।’

অমল কৃষ্ণ বিশ্বাস বললেন, মেয়েটা শেষের দিকে শুধু জানতে চাইত- বাবা আমি কি মরে যাব? তখন মেয়েকে সৃষ্টিকর্তার নাম নিতে বলা ছাড়া তো আর কিছু বলার ছিল না।

দীপান্বিতার শিক্ষক, বন্ধু ও চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন অমল কৃষ্ণ বিশ্বাস। বললেন, হাসপাতালে মেয়ের বন্ধুরা সব সময় পাশে ছিল। কোনো ওষুধ বা রক্ত লাগবে এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুরাই সব ম্যানেজ করে দিত। রক্ত লাগবে শুনে ১১ জন তৈরি হয়ে গেল রক্ত দেওয়ার জন্য। মেয়ের চিকিৎসা, লাশ বাড়িতে নেওয়া পর্যন্ত কে যে কত টাকা খরচ করেছেন তারও হিসাব নেই।

চিকিৎসকেরা কোনো কোনো সময় আশা দিয়েছেন তখন অমল কৃষ্ণ বিশ্বাস ভেবেছেন মেয়ে আইসিইউ থেকে ফিরবে। তবে ডেঙ্গু সব লন্ডভন্ড করে দিল বলে এই বাবা মোবাইলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘ডেঙ্গুতে আমার কতটুকু ক্ষতি হলো, তা তো শুধু আমিই জানি। আমি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে নিজেকে একটু হালকা করার চেষ্টা করি। কিন্তু মেয়ের মায়ের চোখের জল শুকাচ্ছে না। খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছে। এখন আমরা মেয়ের মাকে নিয়ে চিন্তায় আছি। তাঁকে তো কোনো সান্ত্বনাও দিতে পারি না। সামান্য মশা তো আমাদের সবকিছুই শেষ করে দিল। বেঁচে থাকতে হবে, তাই বেঁচে আছি আমরা।’

চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যাটি হাজার ছাড়িয়েছে। অমল কৃষ্ণ বিশ্বাস বললেন, ‘আমার মেয়ের মতো সামনে যে আরও কতজন ডেঙ্গুতে মারা যাবে তা কে জানে। আমার ডেঙ্গু হবে না, ডেঙ্গুতে মারা যাব না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।’ এই বাবার এখন একটাই চাওয়া–‘আপনারা প্রার্থনা করবেন যাতে আমার মেয়ের আত্মাটা শান্তিতে থাকে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.