ঢাকার ওয়ারীতে এক পরিবারের ‘ভয়ংকর রাত’

0
111
আতঙ্কিত রুমানা রিফাত শনিবার রাতে ফেইসবুকে লাইভ করে হামলাকারীদের থেকে তাঁদের রক্ষায় সহযোগিতা চানছবি: ফেইসবুক লাইভ থেকে নেওয়া

‘অসহায় অবস্থায় একটি ভয়ংকর রাত পার করেছি আমরা। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি বাসার ভেতরের গেট ভেঙে তারা ঢুকে পড়ল। শত শত লোক আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশি অস্ত্র নিয়ে বাসার মূল ফটকের ভেতরে ঢুকে হুমকি দিচ্ছিল। তারা পুরো বাসা এমনভাবে ঘিরে রেখেছিল, এখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় ছিল না।’ এ বিবরণ দিয়েছেন ঢাকার নবাব স্ট্রিটের বাসিন্দা রুমানা রিফাত।

রুমানা প্রবীণ আইনজীবী সৈয়দ আজহারুল কবিরের মেয়ে। রুমানার ভাই সৈয়দ ইজাজ কবির একজন ব্যারিস্টার। একটি মারামারির মামলায় গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ওয়ারীর ওই বাসা থেকে এই বাবা-ছেলেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এর দুই দিন পর গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় রুমানাদের বাসার ২ কর্মচারীসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেন ডিবির সদস্যরা। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫ জন রুমানাদের বাসার পাশে একটি মার্কেট ভবন নির্মাণে রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করছিলেন।

আজ রোববার সরেজমিনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে এ ঘটনা ঘটেছে। এতে পুলিশের সদস্যরা যুক্ত হয়েছেন। রুমানাদের বাসার পাশে যে জায়গায় মার্কেট নির্মাণের কাজ চলছে, সেখানকার দুই বিঘা জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের সঙ্গে আল মুসলিম বিল্ডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরোধ চলছিল। শনিবার ডিবির অভিযানে ২ কর্মচারীসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তারের পরই ওই জমি দখল করে নেন মুসলিম বিল্ডার্সের লোকজন। নির্মাণাধীন মার্কেটের দোতলার অংশটি রাতের মধ্যেই ভেঙে ফেলা হয়। বাইরের অংশে টিনের বেড়া দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। জমির দখল বুঝে নেওয়া ব্যক্তিরা বলেছেন, ডিবি ও থানা-পুলিশ ওই জমি তাঁদের দখল করে দিয়েছে।

আর আজহারুল কবিরের পরিবার বলছে, এই জমি দখলের জন্য পরিকল্পিতভাবে বাবা-ছেলের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের গ্রেপ্তারের পর কর্মচারী ও রাজমিস্ত্রিদের গ্রেপ্তার করে রাতের আঁধারে পুলিশের সহায়তায় জমি দখল করা হয়েছে। এখন বাবা-ছেলে যেন জামিন না পান, সে জন্য গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করেছে ডিবি। যদিও ওই মামলার এজাহারে বাবা-ছেলের নাম নেই।

শনিবার রাতের ঘটনার রেশ এখনো কাটেনি সত্তরোর্ধ্ব সৈয়দ আজহারুল কবিরের স্ত্রী মেহেরুন্নেছার। তিনি আজ বলেন, ‘৪৫ বছর ধরে এই বাড়িতে বসবাস করছি। এলাকায় সবাই আমাদের চেনে। এখানে এমন ভয়ংকর একটি রাত পার করতে হবে, কখনো কল্পনাও করিনি।’

ঘটনার বিবরণে মেহেরুন্নেছা বলেন, সন্ধ্যায় ডিবির অভিযানের পর কয়েক শ লোক নির্মাণাধীন মার্কেটে ভাঙচুর শুরু করেন। তাঁদের কারও হাতে ওয়াকিটকি, কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্র আবার কারও হাতে দেশি অস্ত্র ছিল। তাঁরা বাসার মূল ফটকের ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর করেন। অস্ত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। বাসার ভেতরে থাকা পরিবারের সদস্যরা (পাঁচজন নারী, দুজন পুরুষ) ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যান। তাঁরা সবাই বাসার এক কক্ষে এসে অবস্থান নেন।

রুমানা রিফাত জানান, হামলা শুরু হওয়ার পর রাত ৮টা থেকে সারা রাত ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা চেয়েও পাননি। জিম্মিদশার কথা জানিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমেও বার্তা পাঠানো হয়েছিল। ফেসবুকে লাইভ করেও সহায়তা চান তিনি। কিন্তু কেউ তাঁদের সহায়তায় এগিয়ে আসেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়ারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানে আলম মুনশী আজ বলেন, শনিবার রাতেই থানা থেকে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। তারা এসে বলেছে, সেখানে কোনো ঝামেলা নেই। আজ সকালে তিনি ওই বাসায় গেছেন। তিনি তাঁদের বলে এসেছেন, শনিবারই তিনি ওয়ারী থানায় যোগ দিয়েছেন। ঘটনাটি বুঝে উঠতে পারেননি।

‘ডিবি পুলিশ জমি দখল করে দিয়েছে’

৭ ডিসেম্বর সৈয়দ আজহারুল কবির ও তাঁর ছেলে ইজাজ কবিরের বিরুদ্ধে মারামারি ও এক লাখ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ এনে ওয়ারী থানায় মামলা করেছিলেন হেলাল খন্দকার নামের এক ব্যক্তি। তিনি আজ দাবি করেন, বিরোধপূর্ণ ওই জমির একটি অংশের মালিক তিনি এবং অন্য একটি অংশের মালিক আল মুসলিম গ্রুপ। ওই জমি থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করে দখল করেন আজহারুল কবির ও তাঁর ছেলে ইজাজ কবির। তবে সেখানে কতটুকু জমির মালিক তিনি, সেটি বলতে পারেননি। কবে জমি কিনেছেন, সে তথ্যও জানাতে পারেননি তিনি।

হেলাল খন্দকারের ভাষ্য, শনিবার রাতে ডিবি ও থানা-পুলিশ সেখানে গিয়ে আজহারুল কবিরের লোকজনকে গ্রেপ্তার করার পর জমির দখল তাঁদের বুঝিয়ে দেয়। ডিবি ও থানা-পুলিশ কাগজপত্র দেখেই ওই জমি তাঁদের দখল করে দিয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। জমি দখল করার ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই। যা করার ডিবি ও থানা-পুলিশ করেছে।

এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য আল মুসলিম বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল্লাহর মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। মুঠোফোনে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৈয়দ আজহারুল কবির ও তাঁর ছেলে ইজাজ কবিরকে গ্রেপ্তার করেন ডিবির ওয়ারী বিভাগের সদস্যরা। শনিবার রাতের ওই অভিযানও চালিয়েছেন তাঁরা। এমনকি শনিবার রাতে যে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের কারও নাম নেই এজাহারে। তাঁদের অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। যদিও আজ আদালত এই ১৭ আসামিকে জামিন দিয়েছেন।

ডিবির ওয়ারী বিভাগের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে জমি দখল করা হচ্ছে, এমন অভিযোগ পাওয়ার পর শনিবার রাতেই ওয়ারী বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁরা এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন–অর–রশীদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। রাতেই ডিবি প্রধানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। পরে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে আজ তিনি বলেন, ‘ডিবি দখল-বেদখলের কোনো কাজ করে না। ডিবির সুনির্দিষ্ট কিছু কাজ আছে। যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট এফআইআরের ভিত্তিতে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জমি দখলের যে কথা বলছেন, এটা আপনার কাছে প্রথম শুনলাম। তারপরও এ বিষয়ে আমি খোঁজ নিচ্ছি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান আজ বলেন, পুলিশ কারও জমি উদ্ধার করে দিতে পারে না। যদি কেউ সেটা করে থাকে, তাহলে অবশ্যই অন্যায় করেছে। যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকার ওয়ারীতে এই জমি এক পক্ষকে দখলে নিতে পুলিশ ভূমিকা রেখেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছেছ

বাবা-ছেলেকে রিমান্ডে চায় ডিবি

আইনজীবী সৈয়দ আজহারুল কবির ও তাঁর ছেলে সৈয়দ ইজাজ কবিরকে এবার প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় করা মামলায় সাত দিনের রিমান্ড চায় ডিবি। গত শুক্রবার ডিবির রমনা বিভাগের রমনা অঞ্চলের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বাবা-ছেলেকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করেন।

ডিবির আবেদনে বলা হয়, বিএনপির মহাসমাবেশের দিন (২৮ অক্টোবর) আজহারুল কবির ও তাঁর ছেলে ইজাজ কবির (জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক) দেশি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রধান বিচারপতির বাসায় হামলা ও ভাঙচুর করেছেন। প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনের রাস্তায় চলাচলরত একাধিক গণপরিবহন ভাঙচুর করেন। পুলিশের কাজে বাধা, হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশের ওপর আক্রমণ এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির পরিদর্শক রফিকুল আজ বলেন, তাঁরা দুজন এজাহারভুক্ত আসামি নন। তবে তথ্য আছে, তাঁরা দুজন প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলায় জড়িত। এ জন্য রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে রুমানা রিফাত বলেন, ‘আমার বাবা ও ভাই যেন জামিন না পান, এ জন্য পরিকল্পিতভাবে বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনার মামলায় জড়ানো হচ্ছে। ওই মামলায় আমার বাবা বা ভাই, কারও নাম নেই।’

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.