কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে সরকার যেসব সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের কথা বলেছিল, তা অনেকাংশেই পূরণ হয়নি। ডিজিটাল ব্যবস্থার মাধ্যমে দুর্নীতি কমানো, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও অগ্রগতি কম। ডিজিটাল সেবার ক্ষেত্রে প্রতিবেশী ও সমপর্যায়ের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে। যেমন ইন্টারনেটের গতি বাংলাদেশে কম। ডিজিটাল সেবা নিতে যে স্মার্টফোন দরকার, সেই স্মার্টফোন ব্যবহারের হার ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের চেয়েও কম এ দেশে।
আজ ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি।’ যদিও ডিজিটালের ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট। করোনাকালে শহরের শিশুরা ঠিকই অনলাইনে ক্লাস করেছে। গ্রামের শিশুরা বঞ্চিত হয়েছে।
মোটাদাগে বলা যায়, বাংলাদেশ আধা ডিজিটাল হয়েছে। একটি ফর্ম অনলাইনে পূরণ করার সুযোগ তৈরি হলেই তাকে পুরো ডিজিটাল ব্যবস্থা বলা যায় না।
বি এম মইনুল হোসেন, অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অবশ্য তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জনে সরকার শতভাগ সফল। সরকারি সেবাগুলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। করোনা মহামারিতে পুরো ব্যবস্থা অনলাইনে চালু ছিল। স্মার্ট বাংলাদেশ নিয়ে তিনি বলেন, সেখানে চারটি বিষয় গুরুত্ব পাবে—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস, মাইক্রোচিপের নকশা করা ও উৎপাদন এবং সাইবার নিরাপত্তা।
রূপকল্প ও লক্ষ্য
২০০৮ সালে ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প অনুযায়ী জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নীতিমালা করা হয়, যেখানে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। এই নীতিমালা সর্বশেষ ২০১৮ সালের হালনাগাদ করা হয়। সেখানে ৩৩৩টির মতো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছিল।
নীতিমালাটিতে (২০১৮) বলা হয়েছিল, ২০২১ সালের মধ্যে সব সরকারি সেবা যেকোনো স্থান থেকে সহজে, স্বচ্ছভাবে, কম খরচে ও কম সময়ে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পাওয়া যাবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি সেবা কম্পিউটারভিত্তিক হয়েছে, ডিজিটাল হয়নি। যেমন জন্মনিবন্ধনের ফরম এখন অনলাইনে পাওয়া যায়। কিন্তু সেটি প্রিন্ট করে নিয়ে যেতে হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে মানুষকে অন্তত তিনবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়ে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) যাঁদের আছে, তাঁদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে নতুন করে আঙুলের ছাপ দেওয়ার প্রয়োজন থাকার কথা নয়। কিন্তু আঙুলের ছাপ ঠিকই দিতে হয়।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ব্যবসা সহজ করতে এক দরজায় সেবা বা ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার (ওএসএস) চালু করেছে। যদিও তা খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে মানবসম্পদ বেড়েছে, তবে তাদের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে গঠনে সামগ্রিক উন্নয়ন হয়েছে। আমরা সবকিছু টাচ (কিছু কিছু কাজ করা) করেছি। কিন্তু আত্মতুষ্টিতে ভোগা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘সমপর্যায়ের দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে আমরা আরও কী করতে পারতাম, কোথায় যেতে পারতাম, তা ভাবা প্রয়োজন।’
সূচকগুলোয় কী অবস্থা
ডিজিটালের ক্ষেত্রে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান বোঝা যায় বিভিন্ন সূচকে। সে রকম একটি সূচক হলো জাতিসংঘের ই-গভর্নমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (ইজিডিআই)। প্রতি দুই বছর পরপর এই প্রতিবেদনে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোয় অনলাইনে সেবার হার, টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো ও দক্ষ মানবসম্পদের চিত্রটি তুলে ধরা হয়। ২০২২ সালের এই সূচকে দেখা যায়, বাংলাদেশ পাকিস্তান, নেপাল ও ভিয়েতনামের চেয়ে এগিয়ে আছে। পিছিয়ে আছে ভারত ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে। ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১১তম।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নেটওয়ার্ক রেডিনেস ইনডেক্সে (এনআরআই) ১৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তম। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনাম। পিছিয়ে পাকিস্তান ও নেপাল। সূচকটিতে বাংলাদেশের সবল দিক হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার, সাশ্রয়ী মূল্য, টেলিযোগাযোগ সেবায় বিনিয়োগ, ডিজিটাল লেনদেনে শহর ও গ্রামের বৈষম্য কমিয়ে আনা ইত্যাদিকে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের দুর্বল হিসেবে বলা হয়েছে ই-কমার্স নীতি, ইন্টারনেট ব্যবহারে লিঙ্গভিত্তিক ব্যবধান ও নিয়ন্ত্রণের মানকে।
ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান কেবলডটইউকের হিসাবে মোবাইল ইন্টারনেটের দামে ২৩৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। অর্থাৎ এ দেশে ইন্টারনেটের দাম কম। তবে বাংলাদেশের চেয়েও মোবাইল ইন্টারনেটের দাম কম ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে। ইন্টারনেটের গতির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা প্রতিষ্ঠান ওকলার গত অক্টোবরের তথ্যানুযায়ী, ১৪১টি দেশের মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৬তম। বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গ্রাহকই বেশি, ১১ কোটির মতো। যদিও গতিতে দক্ষিণ এশিয়ার সব কটি দেশের পেছনে বাংলাদেশ।
‘আধা ডিজিটাল’
২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে রূপকল্প তৈরির জন্য সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করে গত অক্টোবরে। প্রাথমিকভাবে বলা হচ্ছে, এই রূপকল্পের লক্ষ্য স্মার্ট নাগরিক, সমাজ, অর্থনীতি ও স্মার্ট সরকার গড়ে তোলা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক খাতের কার্যক্রম স্মার্ট পদ্ধতিতে রূপান্তর করা।
ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্প নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, মোটাদাগে বলা যায় বাংলাদেশ আধা ডিজিটাল হয়েছে। একটি ফর্ম অনলাইনে পূরণ করার সুযোগ তৈরি হলেই তাকে পুরো ডিজিটাল ব্যবস্থা বলা যায় না। তিনি আরও বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ করতে গেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), রোবোটিকস, আইওটি ও সাইবার নিরাপত্তা হবে মূল বিষয়। এর জন্য শুধু অবকাঠামো দিয়েই হবে না, দক্ষ মানবসম্পদ সমানতালে গড়ে তুলতে হবে।