‘পড়ালেখায় ভালো ছিলাম না। স্কুলে মার খাইতাম, প্রাইভেটে আর বাড়িতেও মার খাইতাম’—সহজ স্বীকারোক্তি আবু সাঈদের। এই মার খাওয়ার কারণে কিশোর বয়সেই অভিমানে বাড়ি ছেড়েছিলেন সাঈদ। এখন তিনি খেলনা পাখি তৈরি আর বিক্রি করে মাসে আয় করেন অর্ধলক্ষের বেশি টাকা।
আবু সাঈদের বাড়ি যশোরের কেশবপুর উপজেলার বেগমপুর গ্রামে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিজের তৈরি খেলনা পাখি বিক্রি করেন তিনি। গত সোমবার দুপুরে খুলনা নগরের বাস্তুহারা ছাতাপার্ক এলাকায় দেখা হয় সাঈদের সঙ্গে। একটা লাঠির দুই প্রান্তে রং-বেরঙের খেলনা পাখি ঝুলিয়ে বিক্রি করছিলেন তিনি।
আবু সাঈদের বয়স এখন ৩১ বছর। ১৭ বছর ধরে পাখি তৈরি করেন তিনি। আলাপে আলাপে বললেন, যশোরের মনিরামপুরের বেলতলা এলাকার একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতেন সাঈদ। সেখানে পড়া না পারার কারণে প্রায়ই তাঁকে অপদস্থ হতে হতো। পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার কিছুদিন আগে অভিমান করে কেশবপুর থেকে ঢাকাগামী বাসে উঠে পড়েন তিনি। উদ্দেশ্যহীন সেই যাত্রায় নেমে পড়েন সাভারে। সেখানে একজন খেলনা বিক্রেতা নজর কাড়ে সাঈদের। তাঁর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এরপর শুক্কুর মিয়া নামের সেই খেলনা পাখি বিক্রেতা সাঈদকে বাসায় নেন, কাজ শেখান।
আবু সাঈদ বলেন, ‘আমি আমার সমস্যার কথা জানিয়ে বলেছিলাম, থাকার জায়গা ও খাওয়ার জায়গা দিলে আমি মাল বিক্রি করে দেব। তিনি রাজি হয়ে যান। আশুলিয়া, জামগড়া এলাকায় তাঁর বাসায় আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে থেকে কাজ শিখতাম আর বিক্রি করতাম। বছরখানেক পর ওস্তাদ হঠাৎ মারা যান।’ এরপরও সেখানে থেকেই কাজ করতে থাকেন তিনি। একসময় তিনি মায়ের অনুরোধে বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়িতে বসেই শুরু করেন ওস্তাদের কাছে শেখা সেই কাজ।
চার পদের খেলনা তৈরি করেন সাঈদ। টিয়া, কবুতর, মোরগ ও রুপচাঁদা মাছ। খেলনা তৈরির মূল উপকরণ ফোম প্যাড। কেনেন কর্ণফুলী ইপিজেড এলাকা থেকে। এ ছাড়া রং, আঠা, রাবারের সুতা, খড়, চুমকি—এসবও লাগে খেলনা তৈরিতে। মাসে ১৫ দিন খেলনা তৈরি করেন। বাকি ১৫ দিন সেগুলো বিক্রিতে সময় দিতে হয়। সাঈদের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী এবং পরিবারের অন্যরাও খেলনা তৈরিতে সহায়তা করেন।
কথায় কথায় সাঈদ বলেন, একেকজন প্রতিদিন সাধারণত ৩০০ থেকে ৪০০টি খেলনা তৈরি করতে পারে। দক্ষতা থাকলে এক দেড় মিনিটে একটা হয়ে যায়। সাঈদ ও পরিবারের লোকজন মিলে দিনে হাজারখানেক খেলনা বানান। একদিন বাদে একদিন তৈরি করেন। মাসে প্রায় ১৩ থেকে ১৪ হাজার খেলনার অর্ডার থাকে। আর সাঈদ নিজেও খুচরা কিছু বিক্রি করেন।
কোন এলাকায় এসব খেলনা বিক্রি হয়, জানতে চাইলে সাঈদ বলেন, খুলনা, রাজশাহী, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা থেকে অর্ডার আসে। কখনো নিজে গিয়ে, কখনো কুরিয়ারে খেলনা পাঠান। পাইকারিতে প্রতিটি খেলনা ৭ টাকা করে বিক্রি হয়। সব মিলিয়ে মাসে লাখখানেক টাকার খেলনা বিক্রি হয়। একেকটা খেলনার পেছনে দুই থেকে আড়াই টাকার মতো খরচ পড়ে যায়। উৎপাদন খরচ, ব্যক্তিগত খরচ—সব বাদ দিয়ে মাসে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা থাকে।
খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে আবার হিসাবটা আলাদা জানিয়ে সাঈদ বলেন, খুচরায় প্রতিটি খেলনা ১৫, ২০ বা ৩০ টাকা, যার কাছ থেকে যা নেওয়া যায়, সেভাবেই বিক্রি হয়। যখন অর্ডার থাকে না বা কম থাকে, তখন তিনি নিজেই এগুলো খুচরাতে বিক্রি করেন।
খেলনা তৈরিতে প্রথম দিকে সফলতা না আসায় অন্য কাজের চেষ্টা করেছেন সাঈদ। তিনি বলেন, ‘খেলনা তৈরির এই ব্যবসা সব সময় ভালো ছিল না। আবার মাঝেমধ্যে কাজটাকে ছোট কাজ মনে হয়েছে। তাই বিভিন্ন সময় অন্য ব্যবসার চেষ্টাও করেছি। কাঁচামালের ব্যবসা করছি, মিস্ত্রির কাজ করেছি, শিঙাড়া বানিয়েছি, আইসক্রিম বানিয়ে বিক্রি করেছি। সেগুলোর কোনোটিতেই ভালো করতে পারিনি। খেলনা তৈরির কাজটাই আমার জন্য ঠিক আছে। সব দিক দিয়ে এখন ভালো আছি।’
কেমন ভালো আছেন, তার ব্যাখ্যাও দিলেন আবু সাঈদ। তিনি বলেন, ‘ব্যাপক স্বাধীনতা আছে। মনে হলো সারা দিন কাজ করব না, রাতে কয়েক ঘণ্টা কাজ করব, তাতেই হয়ে যাবে। একটা সময় বেশ অভাবের মধ্যে কেটেছে। তবে ব্যবসা থেকে মায়ের কিডনি রোগের চিকিৎসায় আট লাখ টাকা খরচ করেছি। সন্তানদের লেখাপড়া শেখাচ্ছি। এই ব্যবসা থেকে ১৮ শতাংশ জমি কিনেছি, একটা বাড়ি করেছি, বাবাকে একটা দোকান করে দিয়েছি। মোটকথা, ভালোভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি।’