‘টাকায় তো আর কুলায় না ভাই’

0
118

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে রয়েছে ৬-৭টি ডাবের দোকান। সেখানে রোগীর স্বজনের জটলা। কেউ প্লাস্টিকের বোতলে ভরে, আবার কেউ দোকানির দেওয়া পলিথিনে করে ডাবের পানি নিয়ে যাচ্ছেন। জানা গেল, হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ার পর থেকে সেখানে ডাবের তুমুল চাহিদা। আর এ সুযোগে দোকানিরা এক একটি ডাবের দাম রাখছেন ১০০ থেকে ১২০ টাকা। গতকাল সকালে এসব ডাবের দোকানের কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে এক আত্মীয়ের কাছে ১০ হাজার টাকা ধার চাইছিলেন গাজীপুরের বাসিন্দা আতাউর রহমান।

সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তিনি জানান, গাজীপুরের একটি গার্মেন্টে চাকরি করেন। তাঁর সামান্য আয়েই ঘর ভাড়া, সংসার খরচ চলে। ফলে দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির সময়ে মাস শেষে হাতে কোনো টাকা থাকে না বললেই চলে। এর মধ্যে গত ৯ আগস্ট থেকে ছেলের জ্বর। প্রথমে ছেলের রক্ত পরীক্ষা করিয়েছিলেন। কিন্তু ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। অথচ জ্বর কমছিল না। তাই চতুর্থ দিনের মাথায় আবার পরীক্ষা করালে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। রক্তে প্লাটিলেট কমে দাঁড়ায় ৬০ হাজারে। তাই ছেলেকে ঢামেক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়েছেন। চিকিৎসক বলেছেন, ছেলেকে ডাবের পানি, স্যুপসহ ভালো খাবার খাওয়াতে। কিন্তু ভালো খাবার কিনতে গিয়ে খরচে আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। ৫ হাজার টাকা নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন, সেটা শেষ। তাই নতুন করে ধার করার চেষ্টা করছেন।

আরেক রোগীর স্বজন আফরোজা জানান, যাত্রাবাড়ীর কাজলায় তাদের বাড়ি। তাঁর ভাই ডেঙ্গু আক্রান্ত। চার দিন ধরে হাসপাতালের ষষ্ঠ তলায় মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি ডাবের পানি ও স্যুপ খাওয়ান। আফরোজা বলেন, আমরা নিম্ন আয়ের মানুষ। বড় ভাই চাকরি করে আমাদের দুই বোনকে লেখাপড়া করান। উপার্জনকারী ভাই-ই এখন অসুস্থ। তাই ভাইকে সুস্থ করতে ডাক্তার যা যা খাওয়াতে বলেছেন সব খাওয়াচ্ছি। কিন্তু টাকায় তো আর কুলায় না ভাই। তাই ধারদেনা করছি।

আব্দুর রহমান নামে আরেক রোগীর স্বজন জানান, তাঁর ছেলে সৌদি আরব থাকেন। ছেলের বউ ডেঙ্গু আক্রান্ত। হাসপাতালে ভর্তি তিন দিন ধরে। ভর্তির প্রথম দিনেই বিভিন্ন পরীক্ষাসহ ওষুধ কিনতে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। আব্দুর রহমান বলেন, হাতে ২০ হাজার টাকা নিয়ে এসেছিলাম। এখন টাকা প্রায় শেষ। ছেলে কোনো এক কারণে টাকা পাঠাতে পারছে না। অথচ বুঝলাম হাসপাতালে প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ লাগতে পারে। এরই মধ্যে এক ব্যাগ রক্ত ও এক ব্যাগ প্লাটিলেট দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, আরও লাগতে পারে। হাসপাতালে এত ভিড় যে, বাধ্য হয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে।

এদিকে গতকাল ঢামেক হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ভেতর-বাইরে, করিডোরে, মেঝেতে সবখানে ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ওয়ার্ডে পা ফেলার জায়গা নেই। রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক-নার্সরা। ঢাকার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা থেকেও রোগীরা আসছেন। ফলে চাপ বাড়ায় সাধারণ ওয়ার্ডে চলছে ডেঙ্গু চিকিৎসা। হাসপাতালের নতুন ভবনের ষষ্ঠ তলার ৬০১, ৬০২ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডে পুরুষ এবং অষ্টম তলার ৮০১, ৮০২ মেডিসিন ওয়ার্ডে নারী রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। পুরোনো ভবনের দ্বিতীয় তলায় ২০৭, ২০৮ ও ২১০ নম্বর ওয়ার্ডে চলছে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা। সেখানেও খালি নেই শয্যা।

শিশু ওয়ার্ডে কর্মরত এক নার্স বলেন, প্রতিদিনই সুস্থ রোগীদের ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে এবং নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে। কোনো শয্যা খালি নেই। যেভাবে সম্ভব, রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছি আমরা।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, চলতি বছর তারা রেকর্ড পরিমাণ ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দিয়েছেন। বিশেষ করে গত তিন মাসে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিনই অর্ধশতাধিক রোগী ভর্তি হচ্ছে। রোগীর চাপ সামলাতে ওয়ার্ড, মেঝে বাদেও করিডোর, সিঁড়ির নিচে, লিফটের সামনেও বেড দেওয়া হচ্ছে। আবার কেউ পাটি বা চাদর পেতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা আসছেন। আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। যেহেতু রোগীর চাপ বেশি, তাই রোগীর শারীরিক অবস্থা একটু ভালো হলে তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.