মহাযাত্রায় শক্তি প্রদর্শনের বার্তা দেবে বিএনপি

২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ

0
101
বিএনপি

মহাসমাবেশে লাখ লাখ লোকের সমাগম ঘটিয়ে আন্দোলনের মহাযাত্রার শক্তির ‘বিশেষ বার্তা’ দিতে চায় বিএনপি। এবার ‘বিনা চ্যালেঞ্জে’ দলীয় সরকারের অধীনে ‘একতরফা’ নির্বাচন করতে না দেওয়ার বার্তাটি দিতে চায় দলটি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ব্যর্থ আন্দোলন ও সরকারের নির্বাচনী কৌশলের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে বিরোধী দলটি। নানা বাধাবিপত্তি এড়িয়ে আগামী ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ সফল করতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে তারা।

এ কর্মসূচি দিয়েই সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে টানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। এজন্য নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তি প্রদর্শনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওই মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের মহাযাত্রা শুরু হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত যা চলমান থাকবে। শান্তিপূর্ণ কিন্তু ব্যাপক জনসমর্থনের মধ্য দিয়ে দাবি আদায়ের সব রকম কলাকৌশল আর প্রস্তুতি নিতে দলের সর্বস্তরেই নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকমান্ড।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এই আন্দোলন ক্ষমতার লড়াই না, দেশটাকে বাঁচানোর লড়াই, মুক্তির লড়াই। মুক্তিযুদ্ধের পরে এটা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলছে। জনগণ আজ রাস্তায় নেমেছে। এর সফল সমাপ্তির জন্য তাদের নেতাকর্মীর সঙ্গে আজ সাধারণ মানুষও এই সরকারের হাত থেকে বাঁচার জন্য জীবন দিতে রাজি। সুতরাং এরপর তো আর কিছু বলার থাকে না। যারা জীবন দেয়, তাদের সঙ্গে কেউ লড়াই করে কোনো দিন জিততে পারে না।

বিএনপি নেতারা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে ভিসা নীতি ঘোষণার পর কিছুদিন নমনীয় ছিল সরকার। কিন্তু এবার ক্ষমতায় থাকতে মরণকামড় দিতে শুরু করেছে তারা। গত মঙ্গলবার থেকে সরকার আবার আগের অবস্থানে ফিরে যেতে শুরু করেছে। কোনো কারণ ছাড়াই তাদের তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একতরফা নির্বাচন করতে বিএনপি নেতাদের মামলা অত্যধিক দ্রুততার সঙ্গে রায় ঘোষণার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

কিন্তু সরকার যতই চেষ্টা করুক, এবার আর আগের দুটি নির্বাচনের মতো ওয়াকওভার দেওয়া হবে না। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন তারা। রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারকে বাধ্য করা এখন তাদের টার্গেট।

জানা গেছে, নির্বাচনের তপশিলের আগে আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে মরিয়া বিএনপি। লক্ষ্য অর্জনে রাজপথের আন্দোলনের পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি, সমমনা দল ও জোটের বাইরে থাকা অন্যান্য দলের প্রকাশ্য সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনকে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে মাঠে নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে। ছাত্র ঐক্য এবং যুব সংগঠনগুলোকে পৃথক কর্মসূচির ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও যুবক শ্রেণিকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, মহাসমাবেশের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের বার্তা দেবে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। সরকারের দিক থেকে কোনো সমঝোতার উদ্যোগ না নিলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তপশিলের আগ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে রাজপথে থাকার সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। মহাসমাবেশ থেকেই আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। সেখানে রাজধানীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পদযাত্রা, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা– বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন কিংবা সচিবালয় ঘেরাও ও ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি আসতে পারে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সবশেষে হরতাল, অবরোধ ও ঘেরাওয়ের মতো কঠোর কর্মসূচি নিয়েও আলোচনা চলছে। ঘোষিত সব কমসূচিই হবে শান্তিপূর্ণ। তবে বাধা দেওয়া হলে প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ গড়ে তোলার মানসিকতাও থাকবে দলটির। বিএনপি নেতারা জানান, আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঢাকাকেন্দ্রিক হলেও সারাদেশে একযোগে আন্দোলন চলবে। এই আন্দোলনে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হতে পারেন, অনেকে আহত হতে পারেন, সে বিষয়কে সামনে রেখে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। নেতৃত্বের জন্য কয়েকটি ধাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। যাতে একজনের অনুপস্থিতিতে তাৎক্ষণিক আরেকজন সামনে আসতে পারেন, সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

দলটির নেতারা জানান, গত ২৮ জুলাই নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশকে মাইলফলক ধরে এবার তার থেকেও দ্বিগুণ-তিন গুণ বেশি লোকসমাগম ঘটানোর পরিকল্পনা তাদের। এতে ১৫ থেকে ২০ লাখ লোকের টার্গেট নিয়ে কাজ করছেন দায়িত্বশীল নেতারা। স্মরণকালের সবচেয়ে বড় মহাসমাবেশ করে দেশ-বিদেশে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন এবং জনসমর্থনের জানান দিতে চাচ্ছেন দলটির হাইকমান্ড। বিএনপি নেতাদের মতে, মহাসমাবেশে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা আসবে। সরকার গণপরিবহন বন্ধ করতে পারে, বিভিন্ন প্রবেশমুখে তল্লাশি, নেতাকর্মীকে গণগ্রেপ্তার করতে পারে। সেসব বিষয় মাথায় রেখে এবং গুরুত্ব দিয়েই তারা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। পূজার ছুটির পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হতে পারে– এমন সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে নেতাকর্মীকে ঢাকামুখী করার সিদ্ধান্ত রয়েছে তাদের। এবারের বাঁচা-মরার লড়াইয়ে দলের প্রতিটি স্তরের নেতাকর্মীকে সতর্ক করা হয়েছে, তাদের কর্মসূচিতে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার আর সহিংসতা এড়িয়ে ঢাকার কর্মসূচিতে থাকতে বলা হয়েছে। বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীকে ঢাকায় আসার বিষয়ে ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতাদের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। তাদের আসা-যাওয়ার পথে যাতে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা বাধার সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। বাইরে থেকে আসা নেতাকর্মীরা যাতে হোটেল, মেস এড়িয়ে আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবের বাসাবাড়িতে ওঠেন, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, মহাসমাবেশে লোকসমাগম ঘটাতে প্রায় প্রতিদিন প্রস্তুতি সভা, মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গতকাল শুক্রবারও গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিএনপি মহাসচিব ছাড়াও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা, যুগ্ম মহাসচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা উপস্থিত ছিলেন। পৃথকভাবে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড পর্যায়ে নেতাকর্মীর সঙ্গে মতবিনিময় চলছে। একই সঙ্গে দলের অঙ্গসংগঠনের নেতারাও নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।

দলীয় সূত্র জানায়, আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি এখনও নির্ধারণ হয়নি। আজকালের মধ্যে সমমনা গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্যান্য দল ও জোটের সঙ্গে তাদের বৈঠক হতে পারে। সেখানে তাদের মতামত নিয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় তা চূড়ান্ত করা হবে। তবে প্রাথমিকভাবে আন্দোলনের শেষ ধাপ হিসেবে এই মহাসমাবেশের কর্মসূচি থেকেই অন্যান্য দল ও জোটের পক্ষ থেকে সংহতি জানিয়ে একমঞ্চে ওঠার পরিকল্পনা রয়েছে। সে হিসেবে এখান থেকেই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটবে। তবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বিএনপির ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াতের অবস্থান কী হবে, তা স্পষ্ট হয়নি এখনও। সেটা নিয়েও আলাপ-আলোচনা চলছে। জানা গেছে, আন্দোলনে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে বিএনপিতে এখনও স্পষ্টত দুটি ভাগ রয়েছে। একটি অংশ মনে করছে, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে জামায়াতকে সম্পৃক্ত করলে বিএনপির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধরে রাখা যাবে না। আরেকটি অংশ মনে করছে, জামায়াতের সাংগঠনিক শক্তি আর জনসমর্থন কাজে লাগাতে পারলে আন্দোলনের ফসল দ্রুত ঘরে উঠবে। দলের দুই অংশের এমন মনোভাবে তাদের বিষয়টি এখনও দোদুল্যমান রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে ২৮ অক্টোবর যে কোনো প্রক্রিয়ায় মাঠে থাকবে জামায়াত। ২০০৬ সালে লগি-বৈঠার আন্দোলনকে কালো দিবস আখ্যায়িত করে এই দলটি প্রতিবছরই এদিন রাজপথে কর্মসূচি পালন করে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটবে না। তারা পৃথক কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে থাকবে বলে দলটির বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে সমমনার বাইরে থাকা অন্য দলগুলোকেও আন্দোলনের মাঠে আনার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল ও সংগঠনের সঙ্গেও নিবিড় যোগাযোগ রাখছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। সরকার পতনের আন্দোলনকে আরও ত্বরান্বিত করতে তাদের সাংগঠনিক শক্তিকে কাজে লাগাতে চাচ্ছেন দলের হাইকমান্ড। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শুক্রবার ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের ছাত্র ও যুব সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপির প্রতিনিধি দল হিসেবে যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল উপস্থিত ছিলেন। ছাত্র ঐক্যের সঙ্গেও এই দলের ছাত্র সংগঠনকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এই ছাত্র জোটকে আরও সক্রিয় করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় ছাত্র সমাবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের, যদিও দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, মহাসমাবেশের পর তারা বিরতিহীন ধারাবাহিক কর্মসূচিতে যাবেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সব প্রক্রিয়াকেই তারা অবলম্বন করবেন। তবে সবকিছু নির্ভর করবে সরকারের আচরণের ওপর। মহাসমাবেশে বাধা দিলে, হামলা করলে এক ধরনের কর্মসূচি, অন্যথায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন।

কামরুল হাসান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.