চলে গেলেন পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের ৪র্থ সংঘরাজ শ্রীমৎ তিলোকানন্দ মহাথের

0
108
শ্রীমৎ তিলোকানন্দ মহাথের
পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের ৪র্থ সংঘরাজ, এটি এন বাংলা কর্তৃক সাদা মনের মানুষ উপাধি প্রাপ্ত, মায়ানমার সরকার কর্তৃক “অগ্রমহাপন্ডিত ” এর ভূষিত, অনাথ-অসহায়দের সহায়, অনাথ পিতা, কাচালং শিশু সদনসহ বহু প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা তথা মগবান শাক্য মুনি বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত তিলোকানন্দ মহাথের। শ্রদ্ধেয় ভান্তে দীর্ঘদিন ধরেই ডায়াবেটিসসহ কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। ২ নভেম্বর, ২০২৩ মধ্যরাতে ১১:৫৫ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিজ বিহারে যাওয়ার পথে মহাপ্রয়াণে শায়িত হোন । পরম পূজনীয় ভান্তে মহাপ্রয়াণ আগ পর্যন্ত মহাকরুণাময় বুদ্ধের মৈত্রী বানী প্রচার করেছিলেন। এমন পূন্যপুরুষের মহাপ্রয়াণে এলাকার তথা সকল বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা শোকাহত ।
এক নজরে
নাম: শ্রীমৎ তিলোকানন্দ মহাথের
প্রচলিত নাম: বনভান্তে
জন্ম ও জন্মস্থান : ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দ, বেতছড়ি, সুবলং, বরকল, রাঙামাটি
বর্তমান নিবাস: মগবান, মারিশ্যা, বাঘাইছড়ি, রাঙামাটি
সেবামূলক কর্মকান্ড: নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন ও অন্যান্য
এ পর্বে তিলোকানন্দ মহাথেরোর সেবামূলক কর্মকান্ড সম্পর্কে উল্লেখের পাশাপাশি তাঁর পারিবারিক পরিচিতি, বেড়ে ওঠা, শিাজীবন, সংসারজীবন, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, মানুষভাবনা, সমাজভাবনা, দেশভাবনা, রাজনীতি ভাবনা, ধর্মভাবনা ইত্যাদি নিয়ে সংপ্তি আলোচনার প্রয়াস রইল।পারিবারিক পরিচিতি ও বেড়ে ওঠাষাটের দশকে সৃষ্ট অপরিকল্পিত কাপ্তাই বাঁধে চোখের সামনে ভেসে যায় চাকমাসহ কয়েক ল পাহাড়ী মানুষের ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্পত্তি। তিলোকানন্দের পরিবারও সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল অন্য অনেকের মতো। অসহায় চোখে তিনি দেখেছেন সেই ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞ। সেখান থেকেই শুরু নয়, তাঁর অসহায়তার শুরু জন্মের ১ বছর পর থেকেই, যখন মা সিংহাবতী চাকমা তাঁকে রেখে চলে যান কোনো দূর অজানায়। বছর কয়েক পর পিতা কৃষ্ণমনি চাকমাও চলে গেলেন সেখানে, যেখান থেকে কেউ কোনোদিন ফিরে আসেনা। অসহায় মানব শিশু তিলোকানন্দকে পরম আদরে কোলে তুলে নেন কাকী সন্ধ্যাবালা ও কাকা ইন্দ্রমনি চাকমা। শিশুটি যেন কখনো বাবা-মা’র অভাববোধে না ভোগে সে জন্যে যতেœর ত্র“টি ছিল না কাকা-কাকীর। বিধ্বংসী কাপ্তাই বাঁধ তখনো তৈরি হয়নি, তাই পরিবারে কোনো অভাব ছিল না। তবে এক ধরণের স্বচ্ছলতার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠলেও পুনরায় প্রকৃতির বঞ্চনার শিকার হন তিলোকানন্দ। কয়েক বছর পরেই মাতৃতুল্য কাকীকে হারান তিনি। আর ঘনিষ্ট জনদের এমনিতর অনাকাক্সিত মৃত্যু শৈশবে তাঁর মানস গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তিনি তখনি উপলব্দি করেন, মায়াময় এই জগতে স্নেহ-ভালোবাসাসহ সবকিছুই অনিত্য। কারও ভালোবাসাই চিরদিন আনন্দ দিতে পারে না, পারে বেদনা আর বঞ্চনা দিতে। তাই কারও ভালোবাসার আকুতি এবং কারও মৃত্যুই যেন তাঁকে টলাতে না পারে এ জন্যে তিনি আত্মনিগ্রহ বা নিরাসক্তির সাধনা বেছে নেওয়ার সংকল্প করেন। যে করেই হোক, নিজের জীবনচক্রের এই বেদনাবহ বিবর্তন রোধ করে পৌঁছুতে হবে বেদনাবোধহীন অনন্ত সত্ত্বায়।

শ্রীমৎ তিলোকানন্দ মহাথের

 

ভিক্ষুত্ব লাভ

নিজের গভীর সত্ত্বার মধ্যেই তো নিহিত দুঃখ-দৈন্য-বন্ধন সবকিছুর, তাকে জানতে হবে, তাকে আয়ত্ব করতে হবে, পেরুতে হবে সকল বাঁধা বন্ধন। অহং-এর যাতনা আর জগতের যাবতীয় বন্ধন-মায়া থেকে নিজের মুক্তির প্রয়াসে শ্রামণ্য ধর্মে (বুদ্ধ শাসন) দীা নেন তিনি। গভীর মনোযোগ আর ঐকান্তিকতায় পালন করতে থাকেন শ্রামণের শীল, সমাধি আর প্রজ্ঞার তাৎপর্যমাধূর্য। গায়ে গেরুয়া, জীবন চর্যায় কঠোর নিয়মে বন্দি, আর চলতে-ফিরতে, কথায়-কাজে, শয়নে-স্বপনে মুক্তির প্রার্থনা। সর্বদা সতর্কতা যেন গুরুর দীা-শিা-উপদেশ আর পরামর্শ পালনে বিঘœ না ঘটে। সাধনার প্রতি তিলোকানন্দের এমত ভক্তি-ভালোবাসা ও দৃঢ়তায় মুগ্ধ গুরু ভদন্ত রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথেরো তাঁকে উপসম্পদা (ভিু)র দীা প্রদান করেন। ভিুত্ব লাভের সময় তাঁর বয়স মাত্র ১৭ বছর। কৈশোরে সাধনালব্ধ এই অর্জন আরো কঠোর সাধনার দিকে ধাবিত করে তাঁকে। দুঃখ, দুঃখের স্বরূপ আর দুঃখ থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় উপবাস আর অনাহারে এক নাগাড়ে ৭ বছর ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের বিভিন্ন স্থান ও বন-জঙ্গল-সমাধিস্থলে একাকী ধ্যান-সাধনায় মগ্ন থাকেন তিনি। প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় বিশুদ্ধতার প্রভায় দীপ্ত হয়ে ওঠে তিলোকানন্দের মুখাবয়ব। এই একাগ্রতাই আধ্যাত্মিক সিদ্ধি লাভের উপায়।

শিক্ষাজীবন

পাহাড়ী সমাজে তখনো প্রাতিষ্ঠানিক শিার তেমন প্রভাব ও প্রচলন ছিল না। তাই তিলোকানন্দ যখন বিদ্যালয়ে গমন শুরু করেন তখন তিনি বয়সে অনেক বড়। কাকা-কাকীর স্নেহের কাছে পরাস্থ হওয়ায় এতদিন বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাঁদের ভাবনায় ভর করত, খাওয়া-পড়ার পর্যাপ্ত যোগান থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক শিা অর্জন নেহায়েত সময় নষ্ট করা। তবুও পড়াশুনার প্রতি ঐকান্তিক ভালোলাগা থাকায় তিনি স্বেচ্ছায় ভর্তি হন জন্মস্থান সংলগ্ন পাঠশালায়। সেখানে তিন বছর অধ্যয়ন করেই শ্রামণ্য ধর্ম গ্রহণ করে চলে যান চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। সেখানে রাজানগর পালি টোলে পরবর্তী ৩ বছর অধ্যয়ন করে পাড়ি জমান রাঙামাটির রাজবিহারে। সেখানে ত্রিপিটক বিশারদ অগ্রবংশ মহাথেরোর অধীনে দীর্ঘ ৭ বছর অধ্যয়নে নিমগ্ন থাকেন। গুরুর আশীর্বাদে এ সময় ত্রিপিটক বিশারদ হয়ে ওঠেন তিলোকানন্দ মহাথেরো।

সংসারজীবন

শৈশবে পিতা-মাতা ও তৎপরবর্তী সময়ে পিতৃমাতৃতুল্য কাকা-কাকীকে হারিয়ে এক গহীন দুঃখের সাগরে পতিত হয়ে তিলোকানন্দ উপলব্দি করেছেন মানব জীবনের এক করুণ সত্য- ভালোবাসার বিপরীতেই থাকে অসীম বেদনা। আর ভালোবাসার উদ্ভব বন্ধন ও মায়া থেকে। তাই তখন থেকেই যাবতীয় মায়ামুগ্ধতা থেকে নি®কৃতি পেতে বিবাহ না করার প্রতিজ্ঞা করেন তিনি। তাঁর এই সংকল্পে প্রভাবকের ভুমিকা পালন করেছিল কৈশোরে সংঘটিত আরেকটি ঘটনা। তাহলো- নিজ গ্রামের জ্যোতিন্দ্র ও অয়বালার বিবাহ। তারা দুজন একে অপরের সাথে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিয়ে করেছিলেন। অতিশয় সুখে কাটছিলো তাদের দাম্পত্য জীবন। কিন্তু সুখের মাঝেই যে দুঃখের বসবাস এ সত্য কঠোর হয়ে প্রকাশ পেল আরও কিছুদিন পরে। হঠাৎ কয়েক দিনের অসুখে ভুগে মারা যান জ্যোতিন্দ্রেয় প্রিয়তম অয়বালা। আর তার এই মৃত্যু কত করুণ আর বিধ্বস্ত করে দিয়ে যায় জ্যোতিন্দ্রকে, খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিলোকানন্দ। অপ্রকৃতিতস্থ অবস্থায় কেটেছে তার বহুদিন। সাময়িক সুখের পাশে নিদারুন এই দুঃখের বসবাস মেনে নিতে পারেন নি তিলোকানন্দ। পাশাপাশি তৎপরবর্তী সময়ে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করায় আর সাংসারিক চিন্তার অবকাশ হয়ে ওঠেনি তাঁর।

শ্রীমৎ তিলোকানন্দ মহাথের

সেবাসংস্থা : কাচালং শিশু সদন
এক নজরে
সেবাসংস্থার নাম: কাচালং শিশু সদন
অবস্থান: মগবান, মারিশ্যা, বাঘাইছড়ি, রাঙামাটি
প্রতিষ্ঠা: ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ
মারিশ্যা শাখার প্রতিষ্ঠা: ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ
রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্তি: ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ
প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক: ভদন্ত শ্রীমৎ তিলোকানন্দ মহাথেরো
শুরুতে সেবাপ্রাপ্ত শিার্থী সংখ্যা: ১০ জন
বর্তমানে শিার্থী সংখ্যা: ১৮০ জন (আবাসিক ১৫০ জন ছাত্র, অনাবাসিক ৩০ জন ছাত্রী)
শিার্থীদের শিা-স্তর: প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী
সুবিধাপ্রাপ্ত শিার্থীদের ধরণ: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যে কোনো অনাথ-দুঃস্থ শিশু ও সন্ন্যাসব্রত গ্রহণকারী
বর্তমানে অবস্থানগ্রহণকারী শ্রমণ: ১০ জন
এবং ভিক্ষু: ৭ জন
প্রাপ্ত সুবিধাবলী: খাদ্য, শিা, চিকিৎসা ও বস্ত্রসহ যাবতীয় সহায়ক সেবা
ছাত্রাবাস: ৩টি (২ টি মগবানে ও ১ টি মারিশ্যা সদরে)
সাফল্য/ অবদান: এ যাবত সহস্রাধিক শিার্থীকে আশ্রয় প্রদান, যাদের অনেকেই আজ সামাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিষ্ঠিত

উদ্দেশ্যাবলী
ক. জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে এতিম ও দুঃস্থ শিশুদের জন্যে অনাথালয়
খ. সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুদের শিা, চিকিৎসাসহ যাবতীয় মৌলিক অধিকার পূরণ
গ. শিাগ্রহণ শেষে স্বাবলম্বনের ব্যবস্থা
ঘ. জনগণের মধ্যে শিা-সচেতনতা বৃদ্ধি করা
ঙ. বনায়ন কার্যক্রম পরিচালনা
চ. শিার পাশাপশি শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও সৃজনশীল বিকাশে যতœবান হওয়া
ছ. এবং একইসাথে ধর্মীয় শিা প্রদানের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক সিদ্ধি লাভে সহায়তা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.