গ্রিসের উপকূলে নৌযানটি ডুবে যাওয়ার আগে ঠিক কী ঘটেছিল

0
96
গত সপ্তাহে গ্রিস উপকূলের কাছে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসনপ্রত্যাশী বহনকারী একটি নৌযান ডুবে যায়

অভিবাসনপ্রত্যাশী বহনকারী একটি নৌযান গত সপ্তাহে গ্রিস উপকূলের কাছে ভূমধ্যসাগরে ডুবে যায়। এই নৌযান ডুবিতে কয়েক শ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। নৌযানডুবির ঘটনাটি নিয়ে এমন কিছু তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে বিবিসি, যার সঙ্গে গ্রিসের কোস্টগার্ডের ভাষ্য মেলে না।

ভূমধ্যসাগরের যে এলাকাটিতে নৌযানটি ডুবে, সেখানকার অন্যান্য জাহাজের গতিবিধি বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি। বিশ্লেষণে দেখা যায়, মাত্রাতিরিক্ত অভিবাসনপ্রত্যাশী বোঝাই মাছ ধরার নৌযানটি ডুবে যাওয়ার আগে অন্তত সাত ঘণ্টা সাগরে ভাসছিল। নৌযানটি চলছিল না।

তবে গ্রিসের কোস্টগার্ড এখনো দাবি করছে, এই সময়কালে নৌযানটি চলছিল। নৌযানটি ইতালির পথে যাচ্ছিল। নৌযানটিকে উদ্ধারের কোনো প্রয়োজন সে সময় ছিল না।

নৌযানডুবি নিয়ে বিবিসির অনুসন্ধানের বিষয়ে গ্রিসের কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

নৌযানডুবির ঘটনায় কমপক্ষে ৭৮ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। তবে জাতিসংঘ বলছে, এ ঘটনায় এখনো প্রায় ৫০০ ব্যক্তি নিখোঁজ।

নৌযানটি ডুবে যাওয়ার আগেই পূর্ণমাত্রায় উদ্ধার প্রচেষ্টা শুরু করা দরকার ছিল বলে বিভিন্ন পক্ষ থেকে এখন বলা হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে এ দুর্ঘটনা মোকাবিলায় গ্রিসের ভূমিকা তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।

গ্রিসের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, নৌযানটিতে থাকা ব্যক্তিরা (অভিবাসনপ্রত্যাশী) বলেছিলেন, তাঁরা সাহায্য চান না। এমনকি নৌযানটি ডুবে যাওয়ার আগপর্যন্ত তাঁরা বিপদের মধ্যে ছিলেন না।

মেরিটাইম অ্যানালিটিক্স প্ল্যাটফর্ম মেরিন ট্রাফিকের কাছ থেকে ট্র্যাকিং ডেটার একটি কম্পিউটার অ্যানিমেশন হাতে পেয়েছে বিবিসি।

মেরিন ট্রাফিকের এই ডেটায় দেখা যায়, ভূমধ্যসাগরের একটি ছোট, নির্দিষ্ট এলাকায় নৌযানটি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভাসছিল। একই এলাকায় পরে নৌযানটি ডুবে যায়। এই তথ্য গ্রিসের কর্তৃপক্ষের ভাষ্যের ব্যাপারে সন্দেহ তৈরি করে।

গ্রিসের ভাষ্য নিয়ে সন্দেহ

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সীমান্ত বাহিনী ফ্রন্টেক্স বলেছে, তারা প্রথম গত মঙ্গলবার গ্রিনিচ মান সময় (জিএমটি) সকাল ৮টা নাগাদ নৌযানটি শনাক্ত করে। পরে তারা এ তথ্য গ্রিসের কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়।

সমুদ্রে বিপদে থাকা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সহায়তাকারী সংস্থা ‘অ্যালার্ম ফোন’ বলেছে, তারা মঙ্গলবার গ্রিনিচ মান সময় দুপুর ১২টা ১৭ মিনিটে একটি কল পেয়েছিল। সমুদ্রে নৌযানটি সংকটের মধ্যে রয়েছে বলে তারা কল থেকে জানতে পারে।

নৌযানডুবির ঘটনাটি অনুসন্ধানে যাচাইকৃত ভিডিও-স্থিরচিত্রসহ বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি। উল্লিখিত সময়কালে ভূমধ্যসাগরের সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিভিন্ন জাহাজের গতিবিধিও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

মেরিন ট্রাফিকের অ্যানিমেশনে দেখা যায়, গ্রিনিচ মান সময় বেলা ৩টার দিকে ওই সমুদ্র এলাকায় লাকি সেইলর নামের একটি জাহাজ হঠাৎ করে উত্তর দিকে ঘুরছে।
লাকি সেইলরের মালিক কর্তৃপক্ষ জাহাজটির চলাচল-সংক্রান্ত তথ্য (লগবুক) বিবিসিকে দিয়েছে। জাহাজটির মালিক কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে, অভিবাসনপ্রত্যাশী বহনকারী নৌযানটির কাছে যেতে, নৌযানটিতে থাকা ব্যক্তিদের খাবার-পানি দিতে লাকি সেইলরকে নির্দেশনা দিয়েছিল গ্রিসের কোস্টগার্ড।

প্রায় আধঘণ্টা পর গ্রিনিচ মান সময় বেলা ৩টা ৩৫ মিনিটে গ্রিসের কোস্টগার্ডের হেলিকপ্টার নৌযানটিকে খুঁজে পায়। গ্রিসের কর্তৃপক্ষের দাবি, সে সময় নৌযানটি একটি নির্ধারিত গতিপথে চলছিল।

কিন্তু আড়াই ঘণ্টা পর গ্রিনিচ মান সময় সন্ধ্যা ৬টার দিকে একই সমুদ্র এলাকায় ফেইথফুল ওয়ারিয়র নামের আরেকটি জাহাজ দেখা যায়। তারাও নৌযানটিতে সহায়তাসামগ্রী সরবরাহ করেছিল।

জানতে চাইলে ওয়ারিয়র জাহাজের মালিক কর্তৃপক্ষ বিবিসিকে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে।

ওয়ারিয়র জাহাজ থেকে ধারণ করা হয়েছে—এমন ভিডিওতে একটি রশির মাধ্যমে নৌযানটিতে সহায়তাসামগ্রী সরবরাহের দৃশ্য দেখা যায়। ভিডিওতে ঘটনাস্থলে অন্য জাহাজের উপস্থিতি দেখা যায়নি।

হাতে পাওয়া ভিডিও ফুটেজ যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি। ভিডিও ফুটেজে নৌযানটিকে চলতে দেখা যায়নি। ভিডিও ফুটেজে যে নৌযানটিকে দেখা গেছে, তার সঙ্গে প্রাপ্ত স্থিরচিত্রের মিল রয়েছে। তবে ভিডিওটি ঠিক কখন ধারণ করা হয়েছে, তা জানা যায়নি।

গ্রিসের কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে দাবি করেন, গ্রিনিচ মান সময় সন্ধ্যা ৭টা ৪০ থেকে রাত ১০টা ৪০ মিনিটের মধ্যে নৌযানটি নির্ধারিত গতিপথে চলছিল।
গ্রিসের প্রাথমিক বিবৃতিতে বলা হয়, দেশটির কোস্টগার্ড সতর্ক দূরত্ব থেকে নৌযানটিকে পর্যবেক্ষণ করছিল। কিন্তু পরে তারা একটি ‘ক্লোজ-আপ’ ছবি প্রকাশ করে। কিন্তু এই ছবিতে মনে হয়, নৌযানটি কোথাও যাচ্ছে না।

পরে গ্রিসের এক সরকারি মুখপাত্র বলেন, ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য নৌযানটিতে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন কোস্টগার্ডের সদস্যরা। কিন্তু নৌযানে থাকা লোকজন রশি সরিয়ে দেন। তাঁরা সাহায্য নিতে চাননি।

দুর্ঘটনার আগের সাত ঘণ্টার সংশ্লিষ্ট সমুদ্র এলাকার সব শিপিং কার্যকলাপ ইঙ্গিত দেয়, নৌযানটি খুব কম পথই অতিক্রম করেছে।

অ্যানিমেটেড মানচিত্রের তথ্য অনুযায়ী, নৌযানটি মাত্র কয়েক নটিক্যাল মাইল পথ অতিক্রম করেছে। ভূমধ্যসাগরের গভীরতম অংশে বাতাস ও ঢেউয়ের কারণে নৌযানটি এই পথ অতিক্রম করে থাকতে পারে। এ ছাড়া দুর্দশাগ্রস্ত অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নড়াচড়াসহ দুলুনির কারণে নৌযানটি সমুদ্রে কিছুটা পথ অতিক্রম করতে পারে।

গ্রিসের কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, উল্লিখিত সময়কালের মধ্যে নৌযানটি কোনো বিপদের মধ্যে ছিল না। নৌযানটি নিরাপদে ইতালির দিকে যাচ্ছিল। তাই গ্রিসের কোস্টগার্ড নৌযানটি উদ্ধারের চেষ্টা করেনি।

গ্রিনিচ মান সময় রাত ১১টায় নৌযানটি শত শত অভিবাসনপ্রত্যাশী নিয়ে ডুবে যায়। এ সময় ট্র্যাকিং অ্যানিমেশনে দেখা দেখায়, সহায়তার জন্য একাধিক জাহাজ ঘটনাস্থলের দিকে যাচ্ছে।

জাহাজগুলোর মধ্যে ছিল সেলিব্রিটি বিয়ন্ড। জাহাজটি থেকে ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল। দুর্ঘটনার পরের এই ভিডিও বিবিসির হাতে আসে।

সমুদ্র এলাকাটিতে থাকা বিলাসবহুল প্রমোদতরি মায়ান কুইনকে তখন ১০৪ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উপকূলে নিয়ে যেতে সহায়তার নির্দেশ দেওয়া হয়। যাঁরা উদ্ধার হন, তাঁরা নিরাপদে গ্রিসের কালামাটা বন্দরে পৌঁছান। কিন্তু এ ঘটনায় গ্রিসের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েই গেছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.