মানুষের পাঁচ মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য এক নম্বরে। নিয়মিত রোজগার দিয়ে এই চাহিদা মেটাতে পারছেন না অনেক মানুষ। খাদ্য ঘাটতি পূরণে ঋণ করতে হয় দেশের ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবারকে। বছরে গড়ে ৪৯ হাজার টাকা ঋণ করে থাকে এসব পরিবার। আত্মীয়, মহাজন এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকে পরিবারগুলো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্য নিরাপত্তা-সংক্রান্ত জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিবিএসের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে পরিবারের সংখ্যা এখন ৪ কোটি ১০ লাখ। সংস্থার জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১। সেই হিসাবে, দেশের ৪ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ ঋণ করে খাদ্যঘাটতি মেটাতে বাধ্য হচ্ছেন।
খাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যান-২০২৩ নামে প্রতিবেদনটি গত শুক্রবার বিবিএসের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। দেশে খাদ্য নিরাপত্তা-সংক্রান্ত এ ধরনের জরিপ এটিই প্রথম। এ কারণে খাদ্যঋণে খাদ্য সংগ্রহের প্রবণতা আগের তুলনায় বাড়ল না কমলো, তা তুলনা করা সম্ভব হচ্ছে না। জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয় গত ১৫ থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য জাতীয় অগ্রাধিকারভিত্তিক নীতি প্রণয়নে প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যানভিত্তিক উপাত্ত প্রস্তুতের উদ্দেশ্যে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। মাঠ পর্যায়ে মোট ২৯ হাজার ৭৬০ খানা বা পরিবার থেকে সরাসরি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেনের মতে, দেশের অর্থনীতি যে কত ভঙ্গুর, তারই প্রতিফলন বিবিএসের এ জরিপ। সমকালকে তিনি বলেন, এই প্রতিবেদন প্রমাণ করে যে দরিদ্র ছাড়া আরও অনেকে খাদ্যের কষ্টে আছে। সাধারণত ধরে নেওয়া যেতে পারে, দেশে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং তারা কিছুটা খাদ্য কষ্টে থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এক-চতুর্থাংশ পরিবার খাদ্য সংকট লাঘবে ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এর মানে, দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা মানুষও খাদ্যের কষ্টে আছে। এর কারণ হচ্ছে– খাদ্যপণ্যসহ মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, সে হারে মজুরি বা আয় বাড়েনি সাধারণ মানুষের। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন, যাতে নাগরিকদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা অর্জন নিশ্চিত করা যায়। এ ছাড়া অনুচ্ছেদ ১৮(১)-এ বলা হয়েছে, জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করবে।
বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদ্য এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ দেশের জন্য একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে বড় উদ্বেগের বিষয়। এতে আরও বলা হয়, ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে জর্জরিত জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করে কোনো দেশ অর্থনীতির ভিত গড়তে পারে না। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত হতে অবশ্যই খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিতে ব্যাপক আকারে কার্যকর বিনিয়োগ প্রয়োজন।
জানতে চাইলে বিবিএসের সংশ্লিষ্ট জরিপের প্রকল্প পরিচালক আবদুল হালিম বলেন, প্রথমবারের মতো জরিপটি করা হয়েছে। গুরুত্ব বিবেচনায় আগামী দুই বছর পর এ ধরনের জরিপ আবার হতে পারে। তবে এটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, যে কোনো পেশার চেয়ে কৃষিজীবী পরিবারগুলোয় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা সবচেয়ে বেশি। কৃষিকাজের মাধ্যমে খাদ্যশস্য উৎপাদন করে দেশের এমন ২৬ দশমিক ১৩ শতাংশ পরিবার মাঝারি বা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া খাদ্যের চরম বা তীব্র নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে এ ধরনের প্রায় ১ শতাংশ পরিবার। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি দরিদ্রতম পরিবারের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি; সবচেয়ে কম ধনীদের মধ্যে। অর্থাৎ, ধনী পরিবারগুলো খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, সারাদেশে গড়ে ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার খাদ্য ঘাটতি পূরণে ঋণ করে থাকে। গ্রামে এ হার আরও বেশি; ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। শহরাঞ্চলে ২৩ দশমিক ৬ এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবার খাদ্য ঘাটতি পূরণে ঋণ করে থাকে। ঋণের উৎস বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬৮ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার অলাভজনক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। আত্মীয়দের কাছ থেকে ঋণ নেয় ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার। ব্যাংক থেকে ১০ দশমিক ৯ ও মহাজনদের কাছ থেকে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার ঋণ নেয়।
বিবিএসের হিসাবমতে, ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছেন। আর চরম নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছেন ১৭ লাখ মানুষ। প্রতিবেদনে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বলতে খাদ্য গ্রহণ কমানোর উচ্চ আশঙ্কাকে বোঝানো হয়েছে। এটি ক্ষুধাসহ পুষ্টিহীনতার মতো গুরুতর অবস্থায় রূপ নিতে পারে। অন্যদিকে মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বলতে নিয়মিত স্বাস্থ্যকর, সুষম খাবার গ্রহণের অক্ষমতাকে বোঝানো হয়েছে।
খাদ্যপণ্য বাবদ পরিবারের মাসিক ব্যয়ের হিসাবও তুলে আনা হয়েছে বিবিএসের জরিপে। এতে দেখা যায়, জাতীয় পর্যায়ে খাদ্যসামগ্রীর পেছনে পরিবারপ্রতি মাসে গড় ব্যয় ১২ হাজার ৫৩ টাকা। গ্রামে এটি ১১ হাজার ৭১৮ টাকা; শহরে ১১ হাজার ৮৯০ টাকা। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৪ হাজার ১২৫ টাকা।
জরিপে প্রধান খাদ্যপণ্য চাল ও মাছ কেনার খরচের তথ্যও তুলে আনা হয়। এতে দেখা যায়, খাদ্যপণ্যে গ্রামের মানুষের যে খরচ হয় তার ২৪ শতাংশই যায় চাল কিনতে। এ জাতীয় ব্যয়ের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। আবার গ্রামে চাল বাবদ ব্যয় শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকার চেয়ে বেশি। গ্রামে পরিবারপ্রতি মাসে চাল কেনা বাবদ খরচ হয় ২ হাজার ৮২২ টাকা। শহরে লাগে ২ হাজার ৫৪০ টাকা এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় ২ হাজার ২২১ টাকা।