ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বদলে ৩৬০ কোটি টাকা পাচার

অনলাইন জুয়ার সাইট ‘বেট উইনার’

0
165
‘বেট উইনার’

রাশিয়া থেকে পরিচালিত অনলাইন জুয়ার সাইট ‘বেট উইনার’-এর আটজন এজেন্ট রয়েছেন দেশে। তারা দেখভাল করছেন প্রতিষ্ঠানটির আটটি ওয়েবসাইট। আর দুবাইয়ে বসে তাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন ছোটন নামে একজন। এজেন্ট, সহকারীসহ প্রয়োজনীয় জনবল তিনিই নিয়োগ করেন। জুয়ার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া টাকা ভার্চুয়াল মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে রূপান্তর করে তাঁর কাছেই পাঠানো হয়। এর পরিমাণ বছরে প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা। সম্প্রতি এই জুয়া পরিচালনায় যুক্ত চার বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তে এসব তথ্য জানতে পেরেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ বলেন, ৫০টি এমএফএস (মোবাইল ব্যাংকিং সেবা) নম্বর পাওয়া গেছে, যেগুলো দিয়ে জুয়াড়িদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হতো। প্রতিটি নম্বরে প্রতিদিন গড়ে দুই লাখ টাকা ঢুকত। সেই হিসাবে দিনে তারা প্রায় এক কোটি টাকা হাতিয়ে নিত। মাস শেষে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ কোটি টাকায়। এর নগণ্য অংশই এখানের এজেন্টসহ অন্যদের পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হয়। বাকি টাকা পাচার হয়েছে।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন আনুমানিক ২৫ হাজার মানুষ বেট উইনার সাইটে জুয়া খেলেন। তাদের বেশির ভাগই সাধারণ আয়ের মানুষ। খেলা ও টাকা লেনদেনের পদ্ধতি সহজ হওয়ায় গ্রামাঞ্চলের অশিক্ষিত মানুষও এতে জড়িয়ে পড়েছেন। ‘ভাগ্যবদলের’ আশায় জুয়া খেলে টাকা খোয়াচ্ছেন। খুব কম সময়ে তারা খেলায় জিতছেন, মানে বাজির দুই বা তিন গুণ অর্থ ফেরত পাচ্ছেন। এতে উৎসাহী হয়ে আবারও বাজি ধরছেন। এটা তাদের নেশার মতো হয়ে গেছে। পর্যবেক্ষণ বলছে, সাধারণত একজন জুয়াড়ি দিনে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার বাজি ধরেন।

সিআইডির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, জুয়ার ওয়েবসাইটে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জন্য কিছু ফোন নম্বর দেওয়া থাকে। সেগুলো প্রতি ঘণ্টায় বদলে যায়। কারণ, একটি নম্বরে প্রতিদিন লেনদেনের নির্ধারিত সীমা রয়েছে। আবার অস্বাভাবিক বা বেশি লেনদেন হলে নজরদারি কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করবে। এসব কারণে তারা অর্ধশত এমএফএস নম্বর ব্যবহার করে টাকা নেয়। পরে সেই টাকা দুবাই হয়ে রাশিয়ায় পাচার করা হয়।

তদন্ত সূত্র জানায়, বেট উইনারের এ দেশীয় এজেন্টদের এর আগেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত বছর আগস্টের শেষ সপ্তাহে তিন এজেন্টকে গ্রেপ্তার করেছিল সিআইডি। কেউ গ্রেপ্তার হলে সেই স্থানে বিশ্বস্ত অন্য কাউকে নিয়োগ দেয় জুয়া পরিচালনায় যুক্তরা। ফলে সাইট ও জুয়া খেলা চলমান থাকে। আর রাশিয়া থেকে পরিচালিত হওয়ায় এখানে সাইটটি বন্ধও করা যাচ্ছে না।  সর্বশেষ গত ১৪ আগস্ট সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট টিম চারজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা হলেন আরিফুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, হারুন অর রশিদ ও ইমরান হোসাইন। তারা মূল এজেন্টের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন।

এমএফএস নম্বরে আসা জুয়াড়িদের টাকা গ্রহণ এবং কেউ বিজয়ী হলে তাঁকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পাঠানো ছিল তাদের দায়িত্ব। এরপর বাকি টাকা তারা দুবাইয়ে অবস্থানরত ছোটনের কাছে পাঠাতেন।

সিআইডি জানায়, বেট উইনার সাইপ্রাসভিত্তিক মারিকিট হোলিডংস লিমিটেডের জুয়ার সাইট হলেও তা রাশিয়া থেকে পরিচালিত হয়। এ দেশীয় এজেন্টরা জুয়াড়িদের থেকে পাওয়া টাকা একটি বিশেষ মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাপের মাধ্যমে মার্কিন ডলারে রূপান্তর করেন। পরে তা বিভিন্ন দেশের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কাছে (অ্যাকাউন্টে) পাঠানো যায়। এভাবেই তারা বাংলাদেশ থেকে হাতিয়ে নেওয়া বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করছেন। সাইটটির বর্তমান আট এজেন্টের ব্যাপারে কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। এই এজেন্টদের কেউ কেউ আবার বেট ভিসা নামে আরেকটি জুয়ার সাইটের সঙ্গেও যুক্ত। সেটি পরিচালনা করেন মৌলভীবাজারের আরিফ নামে এক ব্যক্তি। মেহেরপুরের একজনও এর সঙ্গে যুক্ত।

জানা গেছে, সম্রাট ও শাহীন রেজা নামে দু’জন বেট উইনারের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে এখন জুয়া পরিচালনাকারীরা সরাসরি অর্থ নেয় না। জুয়ার এজেন্টরাও টাকা লেনদেনের জন্য মধ্যে আরেকটি স্তর তৈরি করেছেন। অসাধু এমএফএস এজেন্টদের ব্যবহার করে তারা জুয়াড়িদের টাকা সংগ্রহ করেন।

ইন্দ্রজিৎ সরকার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.