ক্যানসারে স্বামী ও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন মেয়ে, অটিস্টিক ছেলেকে নিয়ে দিশাহারা দিলশাদ বেগম

0
141
ফাবিহা আফিফা সৃজনী (মাঝে) চলে গেছেন, এখন আছে দুই বোন, ছবি: সংগৃহীত

দিলশাদ বেগমের বয়স ৪৭ বছর। বললেন, ‘২০১৫ সালে ক্যানসারে স্বামী মারা যান। তখন আমাদের একমাত্র ছেলের বয়স ছিল ১০ মাস। ২০১৭ সালে জানতে পারলাম ছেলেটি অটিস্টিক। আর সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ সেপ্টেম্বর মেজ মেয়ে ফাবিহা আফিফা সৃজনী মারা গেছে। এই মেয়ের হাত ধরে থাকা ছোট মেয়ে নোশিন শারমিলি মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছে। প্রায় ৫০ বছরের এই জীবনে ক্যানসার, সড়ক দুর্ঘটনা, অটিজম সবকিছুর সঙ্গেই আমার পরিচয় ঘটে গেছে।’

মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর খিলক্ষেতে দিলশাদ বেগমের লেকসিটি কনকর্ডের নিজস্ব ফ্ল্যাটে বসে কথা হয়। দিলশাদ বেগমের চোখে এখন আর পানি নেই। রাগ বা ক্ষোভও নেই। মেজ মেয়ে সৃজনী সংসারের হাল ধরেছিলেন, মেয়ে মারা যাওয়ায় ভবিষ্যতের সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন দিলশাদ বেগম।

দিলশাদ বেগম জানালেন, স্বামী মারা গেলেন। চিকিৎসক যখন জানালেন ছেলেটি অটিস্টিক, তখন এই মেজ মেয়ে হুট করেই বড় হয়ে গিয়েছিল। একাধিক টিউশনি করে টাকা উপার্জনের পাশাপাশি সংসারের হাল ধরেছিল। বাসার বাজার করা থেকে শুরু করে ছোট ভাইকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে যাওয়াসহ বেশির ভাগ দায়িত্বই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। ফলে দিলশাদ বেগম অনেকটাই নিশ্চিন্ত থাকতে পারতেন। এখন তো আর সে উপায় নেই। ২২ বছর বয়সী মেয়েটাই তো চলে গেল।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন সৃজনী। বাসা থেকে যাতায়াত করতেন, একটানা ক্লাস থাকলে হলে থাকতেন। বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার বাসায় থাকার চেষ্টা করতেন।

মা দিলশাদ বেগমের সঙ্গে ফাবিহা আফিফা সৃজনী  
মা দিলশাদ বেগমের সঙ্গে ফাবিহা আফিফা সৃজনী, ছবি: সংগৃহীত

১ সেপ্টেম্বর ফাবিহা আফিফা সৃজনী নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট বোন নোশিন শারমিলিকে নিয়ে এক বান্ধবীর বাড়িতে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন। ওই বান্ধবীর মা খুব ভালো বিরিয়ানি রান্না করেন, তাই ছোট বোনকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন। দুই বোন হাত ধরেই পূর্বাচলের ৩০০ ফুট এলাকায় অটোরিকশা থেকে নামার পর সড়ক পার হচ্ছিলেন। তারপর যে কী হলো, তা নোশিন শারমিলি এখন আর সেভাবে মনে করতে পারছে না।

দুর্ঘটনার পর ফাবিহা আফিফা সৃজনী অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, মারা যাওয়ার আগে তিনিও কোনো কথা বলে যেতে পারেননি। কোনো এক পথচারী দুই বোনকে উদ্ধার করে প্রথমে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেন। পরে সেখান থেকে বসুন্ধরা এলাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যান। হুড়োহুড়িতে সৃজনীর পরিবারের কেউ ওই পথচারীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাননি।

দিলশাদ বেগম বলেন, সেদিন আসলে কী ঘটেছিল, তা আর বলার উপায় নেই। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ছোট বোনকে বাঁচানোর জন্য সৃজনী ছোট বোনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারলেও নিজে ট্রাকের ধাক্কা থেকে বাঁচতে পারেনি। এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তির পরই লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছিল, সে অবস্থায় মারা যায় মেয়ে। মা জানালেন, ৩ অক্টোবর থেকে মেয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। মেয়ে দেশের বাইরে গিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করার স্বপ্ন দেখত। শুধু নিজে দেশের বাইরে যাবে তা নয়; মা, বোন ও ভাইকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে বলে জানিয়েছিল।

সৃজনীর আঁকা অনেকগুলো ছবি এনে দেখিয়ে দিলশাদ বেগম বললেন, মেয়েটার অনেক গুণ ছিল। বয়সের তুলনায় অনেক বেশি বুঝত। মন চাইলে গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকত।

অটিস্টিক ছেলের সঙ্গে মা দিলশাদ বেগম
অটিস্টিক ছেলের সঙ্গে মা দিলশাদ বেগমছবি: মানসুরা হোসাইন

দিলশাদ বেগমের সংগ্রামী জীবন

সৃজনীর ছোট বোন নোশিন শারমিলির হাত ও পায়ের বিভিন্ন জায়গায় যে আঘাত লেগেছিল, তা শুকিয়ে আসছে। মাথার আঘাত এখনো আছে। এক চোখের নিচে কালো জখম ও চোখের ভেতরের একটি অংশ লাল হয়ে আছে। বোন তাকে খুব আদর করতেন বলে জানাল। সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে শুধু বলল, বোনের হাত ধরে ছিল। রাস্তা পার হচ্ছিল। ট্রাক, গাড়ি দ্রুতগতিতে ছুটছিল। নোশিন শুধু একটি নীল রঙের ট্রাক দেখেছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন তার জ্ঞান ফেরে, তখন সে ছিল এক জায়গায় আর তার বোন ছিল বেশ দূরে। তার বোনকে অনেক লোক ঘিরে রেখেছিল। হাসপাতালে যাওয়ার পথে নোশিন বুঝতে পারে বড় কোনো ঘটনা ঘটেছে। তার বোন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। বড় বোন সৃজনীর ফোন থেকে নোশিন নিজেই ফোন করে খুব ধীরে ধীরে ঘটনাটি মাকে জানিয়েছিল। কেননা সে বুঝতে পেরেছিল, তার অসুস্থ মা এ ঘটনা সহ্য করতে পারবেন না।

দিলশাদ বেগমের স্বামী আবদুল মোমিন খন্দকার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট, ৮৯ ব্যাচ) থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করেছেন। হিসাবি মানুষ ছিলেন না। টাকা উপার্জন করতেন, বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে ঘুরতে পছন্দ করতেন। খিলক্ষেতের ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন আর একটি গাড়ি কিনেছিলেন।

দিলশাদ বেগম বললেন, ‘বোটানিতে মাস্টার্স করেছি। আমার স্বামী যখন মারা যান, তখন তিন মেয়ের বয়স কম আর ছেলের বয়স মাত্র ১০ মাস। ফ্ল্যাটটি ছিল বলে ছেলে–মেয়েদের নিয়ে ঢাকায় থাকা সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন সময় নানা প্রয়োজনে গাড়ি, ঘরের শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি), গয়না, আসবাব, গ্রামের জমি বিক্রি করতে হয়েছে। আমি নিজে চাকরি করতাম। অসুস্থতার জন্য গত বছর চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। বড় মেয়ে রিফা রাফিয়াকে বিয়ে দিয়েছি। মেয়ে ও মেয়ের জামাই তাদের সাধ্য অনুযায়ী আমাদের সহায়তা করে। মেজ মেয়েটা সংসারের হাল ধরেছিল।’

ফাবিহা আফিফা সৃজনীর আঁকা ছবি
ফাবিহা আফিফা সৃজনীর আঁকা ছবি

ছেলে আহমেদ আওসাফের চিকিৎসায় দিলশাদ বেগমকে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয়। ৯ বছর বয়সী ছেলের পেছনেই অনেক খরচ। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্কুলে ভর্তিতে অনেক খরচ হলেও তিনবার সে চেষ্টা করেন, কিন্তু তাতে ছেলে তেমন কিছু শিখছে বলে মনে না হওয়ায় বাতিল করেন। বললেন, ‘ছেলের অটিজম, এ কথা যখন জানতে পারি, তখন শুধু অটিজম শব্দটার সঙ্গেই আমার পরিচয় ছিল। যে পরিবারে এমন একটি বাচ্চা আছে, শুধু তাঁরাই আমার অবস্থা বুঝতে পারবেন। এখন ছেলেকে এলাকার একটি স্কুলে ভর্তি করেছি। বাসায় একজন শিক্ষক রেখেছি। আর বাকি সময়টুকু নিজেই ছেলেকে সময় দিচ্ছি। ছেলে এখন একটু কথা বলা শিখেছে। অন্যান্য আচরণও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে।’

দিলশাদ বেগম তাঁর স্বামীর বন্ধুদের প্রতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ের শিক্ষক ও বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন। বললেন, স্বামীর ক্যানসারের চিকিৎসার সব খরচ দিয়েছেন তাঁর ব্যাচের বন্ধুরা। এই বন্ধুরাই আমার ছেলেমেয়েদের খরচের জন্য তিন বছর ধরে মাসে মাসে টাকা দিচ্ছেন, যা দিয়ে ছেলেমেয়েদের অনেক খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছে। এবার মেয়ের চিকিৎসায় ছয় লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এ টাকাও দিয়েছেন স্বামীর বন্ধু এবং মেয়ের শিক্ষক ও বন্ধুরা।

মেয়ে জীবিত থাকতেই একটি জমি বিক্রির কথা ভাবছিলেন জানিয়ে দিলশাদ বেগম বলেন, ‘মেয়ে মারা যাওয়ার পর হাসপাতালের বিল পরিশোধের জন্য জমি বিক্রির চেষ্টা করি। তবে শেষ পর্যন্ত তা করতে হয়নি। মেয়ের দুর্ঘটনার পর প্রতিবেশীসহ অনেক মানুষ এগিয়ে এসেছেন, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।’

‘আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়’

সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে দিলশাদ বেগম বলেন, মেয়ে এমন আঘাত পেয়েছিল যে তার মাথার খুলি আলাদা করে রাখতে হয়েছিল। পরে অস্ত্রোপচার করে লাগানোর কথা ছিল। মেয়ে তো সেই সময় দিল না। মেয়েকে দেখে সহ্য করতে পারবেন না বলে হাসপাতালে মেয়েকে একবারও দেখেননি। বাসায় আনার পর দেখেছেন।

দুর্ঘটনার আগে ছোট মেয়ের একটি ট্রাক দেখার কথা তুলে ধরে সন্তান হারানো এই মা বলেন, ‘ট্রাক তো রাস্তার রাজা, আমরা তো প্রজা। এখন অনেকেই উল্টো বলছেন, আপনার মেয়েরা এমন ব্যস্ত রাস্তা পার হতে গেল কেন? সে প্রশ্নের উত্তর তো আমি দিতে পারব না। রাস্তায় তো চলতে হবেই।’

ফাবিহা আফিফা সৃজনী (মাঝে) চলে গেছেন, এখন আছে দুই বোন
ফাবিহা আফিফা সৃজনী (মাঝে) চলে গেছেন, এখন আছে দুই বোন, ছবি: সংগৃহীত

দিলশাদ বেগম এ ঘটনায় কোনো মামলা করেননি। তবে আর কোনো মায়ের বুক যাতে খালি না হয়, সে জন্য সরকার সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যাতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়, সে আহ্বান জানালেন তিনি।

নিজের জীবনে একের পর এক ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে দিলশাদ বেগম বললেন, ‘শুধু আমি আর আমার মেয়েরা জানি আমরা কীভাবে এ পথ পাড়ি দিচ্ছি। মাসে আমার নিজের ওষুধই লাগে ১০ হাজার টাকার মতো। কত যে সূক্ষ্ম হিসাবনিকাশ করে চলেছি, তা আমরা জানি। মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েরা সব এক ঘরে ঘুমাত, যাতে বিদ্যুৎ বিল কম আসে। তবে তারপরও আমরা আনন্দে থাকার চেষ্টা করতাম।’

সংসারের আর্থিক খরচের জন্য দিলশাদ বেগম কারও কাছে হাত পাততে চান না। তবে অটিস্টিক ছেলের জন্য কেউ কিছু করতে চাইলে এবং কেন তিনি সহায়তা করতে চাইছেন তার কারণ যদি পছন্দ হয়, তাহলেই কেবল বিষয়টি ভেবে দেখবেন বলে জানালেন তিনি।

স্বামীসহ দিলশাদ বেগমের পরিবারের সদস্যসংখ্যা ছিল ৬। স্বামী মারা গেলেন। বড় মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে থাকছেন। এক মেয়ে মারা গেল। দিলশাদ বেগম বললেন, ‘সৃষ্টিকর্তা হয়তো ইচ্ছা করেই আমার পরিবারের সদস্যসংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছেন। এখন তো আমরা মাত্র তিনজন মানুষ। তবে সব থেকে বড় চিন্তা, আমি যখন থাকব না, তখন আমার অটিস্টিক ছেলেটাকে কার কাছে রেখে যাব?’

মানসুরা হোসাইন

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.