এবার ফুটবল রাঙাল রাঙ্গাটুঙ্গীর মেয়েরা

0
120
অনুশীলনে ব্যস্ত রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির মেয়েরা। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের রাঙ্গাটুঙ্গী ফুটবল একাডেমিতে

মেয়েরা ফুটবল খেলবে—গ্রামবাসীর কত কথা, কত কটূক্তি! সেই কটূক্তি পেছনে ফেলে মেয়েদের সাফল্যে এখন গ্রামের মানুষ গর্ব করেন। পাশাপাশি মেয়েদের খেলায় উৎসাহ জোগান। রাঙ্গাটুঙ্গীর মাঠে বিভিন্ন জেলা থেকে নারী দলের খেলোয়াড়েরা এসে প্রীতি ম্যাচ খেলেন। আর বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বজন ও প্রতিবেশীরা মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁদের মেয়েদের খেলা উপভোগ করেন। ওই দিনের বিকেলটা হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। হাফ টাইমে দর্শকেরা মেয়েদের হাতে তুলে দেন চকলেটসহ নানা খাবার। এই খেলোয়াড়েরা যেন গ্রামের সবার আত্মীয়। ওরা যেন সবার সন্তান।

সোহাগী, স্বপ্না, সাগরিকা—নাম ভিন্ন হলেও পরিচয়টা অভিন্ন। সবাই নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়। অজপাড়াগাঁয়ের একটি একাডেমি থেকে তাঁরা জাতীয় পর্যায়ে জায়গা করে নিয়েছেন। একাডেমিটির নাম রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি। ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরের গ্রাম রাঙ্গাটুঙ্গী।

গ্রামটিতে দিনমজুর, প্রান্তিক কৃষকের পাশাপাশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বসবাস। গ্রামের মাঠে কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে এলাকার মেয়েরা ফুটবলের কলাকৌশল রপ্ত করছেন। তাঁরা এখন খেলছেন জাতীয় ও বয়সভিত্তিক দলের পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে।

শুরুর কথা

রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলত স্থানীয় কিশোর-তরুণেরা। তাদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক তাজুল ইসলাম। ২০১৪ সালের আগস্টে ওই মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করেন স্থানীয় লোকজন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কয়েকজন মেয়েকে ফুটবল নিয়ে ছোটাছুটি করতে দেখেন তাজুল ইসলাম। তখন তাঁর ভাবনায় এল, মেয়েরাও তো ফুটবল খেলতে পারে। খেলা চলাকালে কিশোরীদের ডেকে পরিচিত হলেন। জানালেন ভাবনার কথা। প্রস্তাব পেয়ে মেয়েরাও রাজি হয়ে গেল।

পরের দিন শুরু হয় দল গঠনের কাজ। দল গঠনে সহযোগিতার হাত বাড়ান ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যুবক সুগা মুরমু, স্থানীয় জয়নুল আবেদিন ও সেতাউর রহমান। তবে খেলোয়াড় জোগাড় করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়লেন তাঁরা। মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে অভিভাবকদের আপত্তি আছে। মেয়েরা ফুটবল খেলবে—এটা কেমন কথা! তবে এতে তাজুল, সুগারা দমে যাননি। অভিভাবকদের পেছনে লেগে রইলেন। শেষমেশ তাঁদের অনুরোধে এক এক করে কিশোরীরা মাঠে আসতে শুরু করল। কয়েক দিনের মাথায় ১৫ জনের একটা দল পেয়ে গেলেন তাঁরা। তাঁদের ঘিরেই গড়ে উঠল একটি ফুটবল দল। নাম দেওয়া হলো রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি। আর পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন তাজুল ইসলাম নিজেই।

বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে চলা

মেয়েদের ফুটবল দল গড়ে উঠলেও খেলোয়াড়দের বুট, জার্সিসহ তেমন কোনো সরঞ্জাম ছিল না। প্রান্তিক পরিবারের মেয়েদের পক্ষে ফুটবলের জন্য বাড়তি টাকা জোগান দেওয়াও ছিল কঠিন। তবে তাজুল ইসলাম দমার পাত্র নন। সাধারণ পোশাক আর খালি পায়েই মেয়েদের অনুশীলন চালাতে লাগলেন। পাশাপাশি চলতে থাকে ক্রীড়া সামগ্রী সংগ্রহের চেষ্টা। খেলার পেছনে খরচ করতে করতে বেতনের টাকা কখন ফুরিয়ে যায়, টেরই পান না তাজুল। একসময় স্থানীয় লোকজনও এগিয়ে আসেন। এরপর থেকে তাঁদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

একাডেমির মাঠে নিয়মিত ফুটবল অনুশীলন করে মেঘলা মার্ডি। সে রানীশংকৈল কেন্দ্রীয় উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। বাবা খেতখামারে শ্রম দিয়ে সংসার চালান। মেঘলা মার্ডিও স্বপ্ন দেখে সোহাগী আর স্বপ্নার মতো দেশের হয়ে ফুটবল খেলতে। কথা হলো তার সঙ্গে। মেঘলা বলল, ‘আমি দেশের হয়ে খেলতে চাই। সোহাগী আর স্বপ্না আপুরা পারলে আমরা পারব না কেন?’

জাতীয় নারী ফুটবল দলের নিয়মিত মুখ স্বপ্না রানী। বাবা নীরেন রায় হৃদ্‌রোগে ভুগছেন। কাজ করতে পারেন না। এখন স্বপ্নার আয়ে চলে সংসার। নীরেন জানালেন, যাঁরা মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে নানা কথা বলতেন, এখন তাঁরাই মেয়েদের নিয়ে গর্ব করেন। স্বপ্নার বাবা আরও বলেন, ‘আমার বাড়ি রানীশংকৈল শুনলে অনেকেই বলেন, ফুটবল খেলে স্বপ্না, সোহাগী, সাগরিকাকে চেনেন? তাঁদের যখন বলি, আমিই স্বপ্নার বাবা, তখন তাঁরা আমাকে খুব সম্মান করেন। মেয়ের জন্য গর্বে বুকটা ভরে যায়।’

রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি সূত্রে জানা যায়, এই একাডেমির তিন খেলোয়াড় জাতীয় নারী দলে খেলছেন (স্বপ্না রানী, সোহাগী কিসকু ও কোয়াতি কিসকু)। অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় নারী ফুটবল দলে দুজন (সাগরিকা ও অনন্য মুরমু)। এ ছাড়া আটটি ক্লাবে ২৩ জন খেলোয়াড় নারী ফুটবল লীগে গতবার খেলেছেন।

মেয়েরা দলবেঁধে অনুশীলনে ব্যস্ত। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমিতে
মেয়েরা দলবেঁধে অনুশীলনে ব্যস্ত। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমিতে

দুই বছরের অর্জন

২০১৫ সালটা ছিল একাডেমির জন্য কঠিন সময়। তখন দলটি গড়ে উঠছিল মাত্র। ২০১৬ সালে এসে বেশ শক্তিশালী ফুটবল দলে পরিণত হয় রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির দলটি। একের পর এক জেলা দলকে পরাজিত করতে থাকে ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়েরা। হইচই পড়ে যায় গোটা দেশে। তবে সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ রংপুর জেলা দলের সঙ্গে হেরে বসে দলটি। ২০১৭ সালে একই টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত ছিল ঠাকুরগাঁও জেলা দলের রাঙ্গাটুঙ্গীর মেয়েরা। গাইবান্ধায় হওয়া প্রথম দুই ম্যাচে লালমনিরহাটকে হারায় ১৬-০, আর দিনাজপুর জেলা দলকে হারায় ৮-০ গোলে। ফাইনালে গাইবান্ধা জেলা দলকে ৪-১ গোলে হারিয়ে ঢাকায় যাওয়ার টিকিট নিশ্চিত করে ফেলে তারা। মূল পর্বে ঢাকায় গিয়েও সফল রাঙ্গাটুঙ্গীর মেয়েরা। গ্রুপে টানা তিন ম্যাচ জিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে পৌঁছে যায় ফাইনালে। ফাইনালে অবশ্য কলসিন্দুরের খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া ময়মনসিংহ জেলা দলের সঙ্গে পেরে ওঠেনি দলটি। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে অনূর্ধ্ব–১৪ টুর্নামেন্টেও রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির খেলোয়াড় নিয়ে গড়া ঠাকুরগাঁও ফুটবল দলটি রানার্সআপ হয়।

গেল বছর মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে জয়ী হয় বাংলাদেশ। নারী সাফ বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড় ছিলেন সোহাগী কিসকু আর স্বপ্না রানী। তারা রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির খেলোয়াড়। সোহাগী আর স্বপ্না রানী ছাড়াও জাতীয় দলে এই একাডেমির কোহাতি কিসকুও রয়েছেন। অনূর্ধ্ব-১৭ দলে খেলছে সাগরিকা ও অনন্য মুরমু। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া অনূর্ধ্ব-১৭ নারী সাফ ফুটবলে নেপালের সঙ্গে পিছিয়ে থাকা খেলায় বাংলাদেশের পক্ষে গোল করে সমতা এনেছিল এই সাগরিকা।

একাডেমির খেলোয়াড় কাকলি আক্তার, ঈশরাত জাহান যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় বিশেষ প্রশিক্ষণে পর্তুগাল যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আশা মণি আর মুনিরা আক্তার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গড়ে তোলা নারী ফুটবল দলে খেলোয়াড় হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে।

সরেজমিনে একদিন

৫ এপ্রিল বিকেলে গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, মেয়েরা কেউ সাইকেলে চেপে, কেউ পায়ে হেঁটে মাঠের দিকে যাচ্ছে। কারও কারও পরনে ট্র্যাক-স্যুট, জার্সি আর কাঁধে ব্যাগ। মাঠে গিয়ে দেখা গেল, কেউ বুট পরছে, কারও আবার খালি পা। অনুশীলনের জন্য মাঠে চিহ্ন (মার্কার) বসানো হয়েছে। এসব চিহ্নের ফাঁকফোকর দিয়ে বল আদান-প্রদান চলছে। আবার কখনো চলছে ফুটবল হাতে মাঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত শারীরিক কসরত। তাদের নানা দিকে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন তাজুল ইসলাম আর সুগা মুরমু।

কথা হলো অনুশীলনে আসা মুন্নি আখতার, রঞ্জনা রাণী, চন্দনা, মিনি হেমরম, প্রতিকা রানী, জারমিন আক্তার, সুমী, বেলী সরেন, রুমিতা সরেনসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁদের সবার চোখে আগামীর স্বপ্ন। ফুটবল ও তাঁদের স্বপ্ন নিয়ে জানতে চাইলে সবার যেন একটাই উত্তর, ‘আমরা দেশের

দেশের নারী ফুটবলের অধিকাংশ খেলোয়াড়ই প্রান্তিক পরিবার থেকে উঠে এসেছেন উল্লেখ করে রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির পরিচালক তাজুল ইসলাম বললেন, সবার আগে এই খেলোয়াড়দের সহায়তা দরকার। বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে ওঠা নারী ফুটবল একাডেমিগুলোকে উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান বলেন, রাঙ্গাটুঙ্গী ফুটবল একাডেমি শুধু ঠাকুরগাঁওয়ে নয়, সারা দেশে একটি অনন্য উদাহরণ। একাডেমির নারী ফুটবলারদের অনেকে এখন জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁরা এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চান।

রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির প্রশংসা করে মেয়েদের জাতীয় ফুটবল দলের কোচ গোলাম রব্বানী বলেন, ‘ওরা বেশ ভালো কাজ করছে বলেই দেশের নারী ফুটবলের সব স্তরে এই একাডেমির খেলোয়াড়েরা জায়গা করে নিয়েছেন। আমরা ওদের পাশে সবসময় আছি।’

মজিবর রহমান খান

ঠাকুরগাঁও

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.