এডিস ঠেকাতে ‘বিটিআই’ আনছে ঢাকা উত্তর সিটি, এতে কী হবে

0
218
ডেঙ্গু

ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা নির্মূলে এর উৎসস্থলে আগে আঘাত হানতে হবে—বিশেষজ্ঞদের মত এটাই। কিন্তু সেটা আর কতটা হচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবার মশার উৎসস্থল ধ্বংসে এনেছে বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই)। এটা অনেক দেশে কার্যকর বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিটিআই এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। মশার লার্ভা ধ্বংস করে বিটিআই। এর বৈশিষ্ট্য হলো, এতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই মানুষের শরীরে। শুধু তা–ই নয়, পানিতে এটি প্রয়োগ করলে অন্য জলজ প্রাণীরও এতে ক্ষতি হয় না। বিটিআই বন্দরে এসে এখন কাস্টমসের পরীক্ষার অপেক্ষায় আছে, গত বৃহস্পতিবার এ কথা বলেন উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।

এডিস মশা নির্মূলে বিটিআই কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে অনেক দেশে। এখন ঢাকা উত্তর সিটি উদ্যোগ নিয়েছে এটি আনার। এটা নিঃসন্দেহে ভালো সংবাদ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার

ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপক হারে বাড়ছে রাজধানীতে, ছড়িয়ে পড়েছে দেশের অন্যান্য এলাকায়ও। বাড়ছে মৃত্যু। বছরের শুরুতে লার্ভা জরিপের সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাবধান করেছিল, এবার ডেঙ্গু ব্যাপক হারে বাড়তে পারে। বাস্তবেও তা ঘটছে। পরিস্থিতি নাজুক হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) মুশতাক হোসেন বলেছেন, ‘মহামারি নিয়ন্ত্রণে যেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এখন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তা–ই করা উচিত। ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি পরিস্থিতি হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে। এর নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। উৎসস্থলে এডিস ধ্বংস করা উচিত।’

ডেঙ্গু নিয়ে এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বিটিআই আসার সংবাদ এল। আর এ সংবাদ আশ্বস্ত করেছে কীটতত্ত্ব বিশারদদের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘এডিস মশা নির্মূলে বিটিআই কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে অনেক দেশে। এখন ঢাকা উত্তর সিটি উদ্যোগ নিয়েছে এটি আনার। এটা নিঃসন্দেহে ভালো সংবাদ।’

কলকাতায় এডিসের বিস্তার রোধে বিটিআই ব্যবহার করা হচ্ছে ১৯৯৬ সাল থেকে। এটি বেশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। গত শনিবার পর্যন্ত রাজ্যে ১৬০ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।

কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের চিফ ভেক্টর কন্ট্রোল অফিসার দেবাশীষ বিশ্বাস

বিটিআই কী

যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি) বলছে, মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি হলো বিটিআইয়ের প্রয়োগ। বিটিআই লার্ভা ধ্বংস করে। তবে এটি প্রাপ্তবয়স্ক মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই ব্যাকটেরিয়া প্রাকৃতিকভাবে মাটিতেই জন্মায়। বিশ্বে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এর ব্যবহার চলছে।

বিটিআই কীভাবে কাজ করে

বিটিআই মশা, মাছি এবং অন্যান্য পতঙ্গের লার্ভা মেরে ফেলে। লার্ভা ধ্বংস হওয়ার ফলে মশার সংখ্যা কমে যায়। আর মশার বংশ বৃদ্ধি না হলে চিকুনগুনিয়া, ইয়োলো ফিভার, ডেঙ্গু এবং জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে।

কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, এই ব্যাকটেরিয়ার ক্রিস্টালগুলো মশার লার্ভা খাবার হিসেবে গ্রহণ করে এবং এটি মশার মধ্যে দ্রবীভূত হয়ে বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে। এই পদার্থ লার্ভা মেরে ফেলে। এমনকি মৃত লার্ভাকে যদি জীবিত লার্ভা খেয়ে ফেলে, তাহলে সেই লার্ভাও একপর্যায়ে মারা যাবে। এভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লার্ভার জীবনচক্র ধ্বংস হবে।

বিটিআই কীভাবে ব্যবহার করা যায়

সিডিসির তথ্য অনুযায়ী, বড়ি, তরল, গুলি, পাউডার ইত্যাদি নানা ফর্মুলেশনে বিটিআই পাওয়া যায়। জমে থাকা পানি, বিভিন্ন পাত্রে থাকা পানিসহ পুকুর, নর্দমা, ড্রেন, ডোবা বা যেকোনো স্থানে প্রয়োগ করা যায়। এই লার্ভানাশক যানবাহন, উড়োজাহাজ, হাতে চালিত স্প্রে মেশিনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। মানুষ, পোষা প্রাণী বা অন্য প্রাণী, জলজ প্রাণী ও মৌমাছির জন্য ক্ষতিকর নয়।

এই কীটনাশক যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি (ইপিএ) অনুমোদিত। এই সংস্থার অনুমোদিত কীটনাশকের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। আবাসিক এলাকা এবং অন্য যেকোনো বিস্তৃত এলাকায় ট্রাক বা আকাশ থেকে বিটিআই স্প্রে করার বিষয়টি নিরাপদ বলেই প্রমাণিত হয়েছে। আবাসিক এলাকা ছাড়াও বাণিজ্যিক এবং কৃষি ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহার করা হয়। জৈব (অর্গানিক) কৃষির ক্ষেত্রে এর ব্যবহার আছে। ব্যবহার বিধি মেনে বিটিআই জমাট বাঁধা পানিতে প্রয়োগ করা যায়। যেখানে মশা ডিম পাড়তে পারে। তবে এর প্রয়োগে খাদ্যশস্য বা পানির কোনো ক্ষতি হয় না।

সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিটিআই সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে করে সিডিসি। এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কলকাতা সিটি করপোরেশন এখন পর্যন্ত ভালো সফলতা পেয়েছে। তাদের সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি খুব কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের চিফ ভেক্টর কন্ট্রোল অফিসার দেবাশীষ বিশ্বাস বলেন, কলকাতায় এডিসের বিস্তার রোধে বিটিআই ব্যবহার করা হচ্ছে ১৯৯৬ সাল থেকে। এটি বেশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। গত শনিবার পর্যন্ত রাজ্যে ১৬০ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।

বিটিআই পাউডার আকারে নিয়ে আসছে ডিএনসিসি। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মশকনিধনে ব্যবহৃত কীটনাশক নির্বাচন কমিটির ২০২১ সালের ১১ অক্টোবর এবং চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরীক্ষামূলকভাবে বিটিআই ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে তারা সেটা কেনার কোনো প্রক্রিয়া শুরু করেনি। ডিএসসিসি ডেঙ্গুর লার্ভা ধ্বংসে টেমিফস নামের একটি কীটনাশক ব্যবহার করে।

দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবীর বলেন, ‘টেমিফস যথেষ্ট কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমরা আপাতত এর পরিবর্তনের কথা ভাবছি না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মপদ্ধতি থাকে। উত্তর সিটি বিটিআই ব্যবহার করতে চায়, এটা তাদের সিদ্ধান্ত। আমাদের নিজস্ব একটি কারিগরি কমিটি আছে। ভবিষ্যতে যদি তারা বিকল্প কোনো কিছুর কথা বললে আমরা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’

পাশাপাশি দুই সিটির একটিতে বিটিআইয়ের ব্যবহার হলে অন্যটিতে না হলে ঢাকার মশার নিয়ন্ত্রণ কতটুকু কার্যকর হবে? জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, এক একটি প্রতিষ্ঠান, তার নিজস্ব চিন্তা–চেতনা ও পরিকল্পনামাফিক কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে যে কীটনাশকটি বেশি কার্যকর, পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যঝুঁকি কম, সে ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করাই উত্তম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.