মিডিয়া সেন্টারের ঠিক কাছেই আছে একাধিক ব্রিফিং রুম। সেখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। এডিবি সম্মেলনের তৃতীয় দিন আজ (বৃহস্পতিবার) সকাল ১০টায় সামান্থা হাংয়ের মিডিয়া ব্রিফিং পূর্বনির্ধারিত ছিল। তিনি এডিবির লিঙ্গসমতা বিষয়ের প্রধান। তিনি জানালেন, এডিবির লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের ৭৫ শতাংশ সার্বভৌম বা সার্বভৌমহীন ঋণেই লিঙ্গসমতাকে অন্তর্ভুক্ত করে এগিয়ে নেওয়া।
ওদিকে তখন চলছিল সম্মেলনের অন্যতম মূল অধিবেশন, এডিবির সদস্যদেশগুলোর প্রতিনিধিদের অধিবেশন। সেখানে সবাই যাঁর যাঁর দেশের হয়ে মূল বক্তব্য দিয়েছেন। এতে অর্থনীতির নানা প্রসঙ্গ এসেছে, আছে পরিকল্পনার কথা, সমস্যা ও প্রয়োজনের কথাও। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। তবে মিডিয়া সেন্টারে থাকা স্ক্রিনে তা সম্প্রচার করা হচ্ছিল। তখনই দেখা গেল, বক্তব্য দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান।
শরিফা খান স্থানীয় সময় সকালে বক্তব্য দিয়েছেন, কিন্তু বাংলাদেশ সেখানে কী বলেছে, তা বিকেল পর্যন্ত জানা যায়নি।
এডিবির এ সম্মেলন নিছকই দেখা সাক্ষাতের রুটিন বৈঠক নয়। এটি মূলত অর্থনীতিতে এশিয়ার নীতিনির্ধারকদের সবচেয়ে বড় সম্মেলন। এখানে এসেছেন এশিয়ার প্রায় সব দেশের অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা। তাঁদের বেশির ভাগই এসেছেন উদ্বোধনের আগের দিন ২ মে।
এর পর থেকে অর্থমন্ত্রী ও গভর্নররা একাধিক বৈঠক করেছেন। বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন; সংবাদ সম্মেলনও করেছেন তাঁরা। এর মধ্যে ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ এসেই এডিবি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেন। এডিবি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলায় যে নতুন ঋণ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে, সেখান থেকে ঋণ চেয়েছেন তিনি।
আবার আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজর ছিল কোরিয়ার অর্থমন্ত্রী ও জাপানের অর্থমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের প্রতি। দক্ষিণ কোরিয়ার উপপ্রধান মন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী চু কিয়ং-হো এবং জাপানের অর্থমন্ত্রী শুনিচি সুজুকির মধ্যকার বৈঠক ছিল গত সাত বছরের মধ্যে প্রথম অর্থমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানের কোরিয়া দখল রাখার ঘটনায় এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্কের যথেষ্ট টানাপোড়েন আছে।
দুই অর্থমন্ত্রী বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় জাপানের অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘নানা ধরনের ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে আমরা আছি। এর মধ্যে নানা ঘটনা ঘটছে। যেমন উত্তর কোরিয়ার নিউক্লিয়ার মিসাইলের উন্নয়ন ও রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ, যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। সুতরাং এসব বিষয়ে দুই দেশকে একযোগে কিছু করতে হবে।’
কোরিয়ায় এসে আসিয়ানভুক্ত ১০ দেশসহ আরও ৩টি দেশের অর্থমন্ত্রী ও গভর্নররা এক বিশেষ বৈঠক করেছেন। এর নাম দেওয়া হয়েছে আসিয়ান প্লাস থ্রি বা আসিয়ান ও তিন দেশ। বাকি তিন দেশ হলো জাপান, কোরিয়া ও চীন। এ বৈঠকেই ব্যাংকিং খাত নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে বলে রয়টার্স জানাচ্ছে।
২০২০ সালে মহামারি কোভিড-১৯-এর বিস্তার বাড়লে এডিবি আর সরাসরি সম্মেলন করতে পারেনি। সম্মেলন হয়েছে ঠিকই, তবে অংশ নিতে হয়েছে অনলাইনে। কোভিডের আগ্রাসন কমে যাওয়ায় তিন বছর পর এবারই প্রথম অনুষ্ঠিত হচ্ছে সশরীর বৈঠক। সুতরাং এশিয়ার অর্থনীতির নীতি নির্ধারকেরা এ সুযোগ একেবারেই ছেড়ে দেননি। সবাই এসেছেন, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও হচ্ছে, সবাই অভিজ্ঞতা বিনিময় করছেন; করণীয় ঠিক করছেন অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নররা।
সম্মেলনের বিভিন্ন বৈঠকে খুব স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক ব্যাংকের পতনের বিষয়টি উঠে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে রকম আগ্রাসীভাবে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে, তাতে অন্যান্য দেশের ব্যাংক খাতেও সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা বলেছেন এশিয়ার নীতিনির্ধারকেরা।
ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ পরিষ্কার বলেছেন, নীতি সুদ বাড়ানোর যুদ্ধে তিনি শামিল হবেন না। কারণ, ভারতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনেক শিল্প আছে। সুদহার বাড়ালে তারা সমস্যায় পড়বে। একই মত কোরিয়া ও জাপানেরও। এ অবস্থায় করণীয় নিয়ে আলোচনা এখনো চলছে। মূল্যস্ফীতি কমানো, সরবরাহব্যবস্থা ঠিক করার বিষয়েও কথা বলছেন প্রতিনিধিরা।
অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরদের এই মিলনমেলায় জাপান ও কোরিয়ার প্রাধান্য তো আছেই, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধিদলের প্রধানেরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধিত্ব করছেন দেশটির সাবেক অর্থমন্ত্রী, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী সাবরি। তিনি দেশের অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে কথা বলছেন। এসেছেন চীনের উপ-অর্থমন্ত্রী। সব মিলিয়ে বলা যায়, প্রায় সব দেশই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। অর্থাৎ অর্থনীতির মূল নীতিনির্ধারকেরাই এখানে এসেছেন।
এ ক্ষেত্রে অন্যতম ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের প্রধান ইআরডি সচিব, যাঁর কাজ মূলত ঋণ বা সাহায্য নিয়ে আলোচনা করা। ৩ মে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশের পক্ষে তিনি এখানে কোন কোন কর্মসূচিতে থাকবেন। জানা গেল, কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একটি ঋণচুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে, যদিও তা এডিবির সম্মেলনের কোনো বিষয় নয়। এর বাইরে আজ বৃহস্পতিবার তিনি মূল আনুষ্ঠানিক অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের প্রধান হিসেবে বক্তব্য দেন।
কিছুক্ষণ পরেই এডিবির পক্ষ থেকে একটি লিংক পাঠানো হয়। সেখানে প্রতিনিধিদলের বক্তব্য আলাদা আলাদা করে দেওয়া আছে। শরিফা খান বক্তব্য দিয়েছেন সকালেই। এখন পর্যন্ত ৪১টি দেশের পক্ষ থেকে দেওয়া বক্তব্য তুলে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেখানে নেই বাংলাদেশ। সুতরাং জানা গেল না বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে কী বলেছে। তবে এখানে এসে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, অংশগ্রহণই বড় কথা—অলিম্পিক গেমসের এই মর্মকথাই এখানে মনেপ্রাণে ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।
অথচ বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য অন্যতম উৎস এডিবি। এখন পর্যন্ত এডিবি বাংলাদেশের সঙ্গে ৭০১টি প্রকল্পে ২ হাজার ৮৩০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করেছে, যার মধ্যে এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে ২ হাজার ১১৯ কোটি ডলার।
ইঞ্চনের অবস্থান দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের ঠিক পাশেই। ১৯৬০-এর দশকে এই দুই শহরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে যে এক্সপেস হাইওয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল, তার অর্থ দেয় এডিবি। এই ইঞ্চনেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে এডিবির ৫৬তম বার্ষিক সম্মেলন। মোট পাঁচ হাজার প্রতিনিধি এতে অংশ নিচ্ছেন। ইঞ্চনের সুবিশাল সংদো কনভেনসিয়া সেন্টারে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন কক্ষে হচ্ছে বৈঠক ও সেমিনার। কেবল সরকারের প্রতিনিধিরাই নন, অংশ নিচ্ছেন বেসরকারি খাত ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও। তাঁরাও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈঠক করছেন।
দক্ষিণ কোরিয়া উচ্চ প্রযুক্তির দেশ। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে বিভিন্ন ধরনের উপস্থাপনাও আছে সেন্টারজুড়ে। পথ চলতে দেখা মিলছে রোবটের। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারও নানা উপস্থাপনা আছে সেখানে। বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে এসেছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাও।
এর ফাঁকে হয়ে গেল আরও চারটি মিডিয়া ব্রিফিং। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সর্বশেষ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানালেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের পরিচালক কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন ও উপপরিচালক থমাস হেলব্লিং।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিপুল অবকাঠামোর চাহিদা মেটাতে কীভাবে গ্রহণযোগ্য প্রকল্প নেওয়া যায়, তা নিয়ে ব্রিফিং করেন সংস্থার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি বিভাগের প্রধান ক্লেও কাওয়াআকি।
আর সবশেষে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মিডিয়া ব্রিফিং করেন এডিবির জলবায়ু দূত ওয়ারেন ইভানস।