উত্তপ্ত ঢাকায় গাছ লাগানো নিয়ে পরিহাস

0
75
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম গতকাল বুধবার রাজধানীতে আগামী দুই বছরের মধ্যে দুই লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছেন

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ‘সবুজ ঢাকা’ গড়তে চেয়েছিলেন। ২০১৫ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৬ সালের মে মাসে তিনি ‘সবুজ ঢাকা’ প্রকল্প উদ্বোধন করেছিলেন।

অনেকটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে উদ্যোগটি নিয়েছিলেন আনিসুল হক। তিন বছরে উত্তর সিটি এলাকায় পাঁচ লাখ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা ছিল তাঁর। আনিসুল হকের উদ্যোগে উত্তরা এলাকায় কয়েক হাজার গাছ লাগানোও হয়।

২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর যুক্তরাজ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আনিসুল হক মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর গাছ লাগানোর উদ্যোগটি থমকে যায়। ২০১৮ সালের মে মাসে ডিএনসিসির পরিবেশ সার্কেল থেকেবলা হয়েছিল, আনিসুল হক ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গাছ লাগানোর কাজটি করছিলেন। গাছ লাগানোর এই উদ্যোগের বিষয়ে ডিএনসিসির আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত নেই।

ফলে আনিসুল হকের মৃত্যুর পর ঢাকাকে সবুজ করতে ডিএনসিসির দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। আনিসুল হকের ‘সবুজ ঢাকা’ প্রকল্প উদ্বোধনের ঠিক সাত বছর পর আরেক মে মাসে ডিএনসিসির বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলাম রাজধানীতে আগামী দুই বছরের মধ্যে দুই লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছেন। ঢাকার তীব্র তাপপ্রবাহের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গতকাল বুধবার এই ঘোষণা দেন তিনি।

এ বিষয়ে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই শহরকে গরম (তাপপ্রবাহ) ও দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে গাছের বিকল্প নেই। আমরা এখন এই বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। ফুটপাত ও সড়ক বিভাজকে বনজ বা ফলদ—কোন গাছ লাগানো হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে উদ্যানতত্ত্ববিদদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। ডিএনসিসির কাউন্সিলরদের মাধ্যমে পাড়া-মহল্লার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গাছ লাগানোর এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।’

আনিসুল হকের মৃত্যুর সাড়ে পাঁচ বছর পর ঢাকার সবুজায়নের গুরুত্ব অবশেষে ‘উপলব্ধি’ করলেন তাঁর উত্তরসূরি আতিকুল ইসলাম। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে: ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’। অর্থাৎ, একেবারে না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়া ভালো।

তবে সাড়ে পাঁচ বছর অনেক সময়। এই সময়ে সবুজ হারিয়ে ঢাকা আরও ধূসর হয়েছে। আনিসুল হকের উদ্যোগটি এগিয়ে নিলে ঢাকার সবুজ এলাকা বাড়ত বলে মনে করছেন নগরবিদেরা।

ডিএনসিসি তার প্রতিবছরের বাজেটে বৃক্ষরোপণ বাবদ একটা অর্থ বরাদ্দ রাখে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বৃক্ষরোপণের জন্য দুই কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল সংস্থাটি। কিন্তু এই খাতে একটি টাকাও খরচ করা হয়নি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ ‘ঢাকা নগরীর সবুজ এলাকা এবং এর রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শিরোনামে গত বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর মেয়াদে একটি গবেষণা করে। গত ২১ মার্চ গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ঢাকা মহানগরে ২০ ভাগ সবুজ এলাকা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে আছে সাড়ে ৮ ভাগেরও কম। ২০০২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বার্ষিক ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সবুজ এলাকা হারিয়েছে ঢাকা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ঢাকা একসময় সবুজহীন নগরে পরিণত হবে। এখন মহানগরে যতটুকু সবুজ আছে, তা-ও নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে নগরবাসী সবুজের সুবিধা পায় না।

গত বছর স্প্রিনজার নেচারের থিওরেটিক্যাল অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড ক্লাইমেটোলজি সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের ভূপৃষ্ঠ এলাকা ২৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ সম্প্রসারিত হয়েছে। একই সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছে ৭৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গবেষণা দলের সদস্য মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের ভাষ্যে, এর মানে হলো, ঢাকা শহরের সবুজ স্থান ও জলাভূমি কমে গেছে। শহরে বেড়েছে মানুষ ও বসতি।

গবেষণাটিতে বলা হয়, ঢাকার মূল বসতি ও বাণিজ্যিক এলাকার একটা বড় অংশ তাপীয় দ্বীপে (হিট আইল্যান্ড) পরিণত হয়েছে। ঢাকার ঠিক বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ এলাকার সঙ্গে রাজধানীর ভূপৃষ্ঠীয় তাপের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার সবচেয়ে উত্তপ্ত এলাকাগুলোর (তাপীয় দ্বীপ) মধ্যে রয়েছে—তেজগাঁও, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, পল্টন, মতিঝিল, গুলশান, বনানী, রামপুরা, বনশ্রী, মাদানী অ্যাভিনিউ, উত্তরা, মিরপুর, শেওড়াপাড়া।

গবেষক, নগরবিদ ও পরিবেশবিদেরা বলছেন, ঢাকায় একটি উত্তপ্ত, অসহনীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যাপকভিত্তিক সবুজায়ন দরকার। কারণ, এই নগরের উত্তাপ কমাতে পারে সবুজ। সবুজায়ন না ঘটাতে পারলে ঢাকা শহরের অবস্থার আরও অবনতি হবে।

ঢাকা শহরের আরেকটি গুরুতর সমস্যা রয়েছে—বায়ুদূষণ। পরিবেশবিদেরা বলছেন, শহরে সবুজ যত কমে, বায়ুদূষণ তত বাড়ে। তাই ঢাকার সবুজ এলাকা বাড়াতে হবে।

কাটা পড়ছে গাছ

সড়কদ্বীপ উন্নয়নের নামে সম্প্রতি গাছ কেটেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে সড়ক উন্নয়নের অংশ হিসেবে গত জানুয়ারিতে গাছ কাটা শুরু করে সংস্থাটি। গাছ কাটার প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন এলাকাবাসী। তিন মাস বন্ধ থাকার পর গত সোমবার রাতে আবার গাছ কাটা শুরু হয়। পরে স্থানীয় লোকজনের প্রতিবাদের মুখে বন্ধ হয় গাছ কাটা। তবে তার আগেই কেটে ফেলা হয় শতাধিক গাছ।

উন্নয়নের নামে আগেও রাজধানীতে সবুজ ধ্বংস করা হয়েছে। উন্নয়নের নামে ওসমানী উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্কের গাছ কাটা হয়েছে।

নগর গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, শহরকে সবুজ রাখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। উত্তপ্ত ও দূষিত বায়ুর এই শহরের জন্য সবুজ খুব দরকার। আনিসুল হকের উদ্যোগটা এগিয়ে নিলে এত দিনে তার সুফল পাওয়া যেত। এখন নতুন করে গাছ লাগানোর ঘোষণা দিতে হতো না। তা ছাড়া ঢাকায় বৃক্ষায়ন নিয়ে সার্বিক কোনো পরিকল্পনা নেই। এ নিয়ে পরিকল্পনা দরকার। আর গাছের পরিচর্যা-রক্ষণাবেক্ষণসহ বৃক্ষায়ণ কার্যক্রমে নাগরিকদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.