ইরাকের তুলনায় ইউক্রেন পরিস্থিতি কিছুই নয়

নোয়াম চমস্কি

0
106
সাইফুর রহমান তপন।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য নিউ স্টেটসম্যানের ইউরোপ প্রতিনিধি ইডো ভক সম্প্রতি এক ভিডিওকলে মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কির সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেন। ২৯ এপ্রিল প্রকাশিত ওই আলাপচারিতা জন্য ভাষান্তর করেছেন সহকারী সম্পাদক সাইফুর রহমান তপন।

আমরা জানি, আপনার বাবা ইউক্রেনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যিনি ১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। ইউক্রেনে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই।

ইউক্রেনের কোনো স্বাধীন সত্তা নেই; তারা যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল, যে শুধু রাশিয়াকে দুর্বল করার জন্য কিয়েভকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি বরং এক ধরনের দরকষাকষির হাতিয়ার। বিশাল সামরিক বাজেটের ক্ষুদ্র একটি অংশের বিনিময়ে এ যুদ্ধে সে তার একমাত্র প্রকৃত সামরিক প্রতিপক্ষকে ভয়াবহভাবে হেয় করতে পারছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের ইন্ধনে ইউক্রেন শান্তি আলোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন এটি করেছে তাদের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থে। অথচ ইউক্রেন বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত হয়ে চলেছে।

কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনা হলে কি লাখ লাখ ইউক্রেনীয়কে একটি আগ্রাসী শক্তির কাছে সমর্পণ করা হবে না?

রাশিয়া বেশ সংযমের সঙ্গে কাজ করছে। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময় যুক্তরাষ্ট্র যা করেছিল, রাশিয়া তার ধারেকাছেও যায়নি। ইরাক আগ্রাসনে পরিকাঠামোর যে পরিমাণ ধ্বংসলীলা চলেছিল, ইউক্রেনে তার সামান্যও ঘটেনি। রাশিয়া কিন্তু চাইলে কিয়েভকে বাগদাদের মতো বসবাসের অযোগ্য করে তুলতে পারে। পশ্চিম ইউক্রেনের সরবরাহ লাইনে আক্রমণ করতে পারে।

আপনি বলতে চাচ্ছেন, রাশিয়া ইউক্রেনে– ইরাকে মার্কিন ধ্বংসযজ্ঞের তুলনায় অনেক বেশি মানবিকভাবে যুদ্ধ করছে?

আমি তা বলছি না। আমার কথা স্পষ্ট। ইরাকে আগ্রাসন শুরুর পর জাতিসংঘের পরিদর্শক প্রতিনিধি দলকে প্রত্যাহার করতে হয়েছিল; আক্রমণটি এতটাই ভয়াবহ এবং চরম ছিল। আসলে মার্কিন এবং ব্রিটিশ যুদ্ধের ধরনই এমন। হতাহতদের দিকে নজর দিন। আমি শুধু সরকারি সংখ্যা জানি… জাতিসংঘের হিসাবে প্রায় ৮,০০০ বেসামরিক লোক ইউক্রেনে হতাহত হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের হাতে ইরাকে কতজন বেসামরিক লোক হতাহত হয়েছিল? শুধু তাই নয়; যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যে বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কিয়েভ ভ্রমণ করেছেন, তা রাশিয়ার সংযমের প্রমাণ। আর যখন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন বাগদাদকে টুকরো টুকরো করে ফেলছিল, তখন কি কোনো বিদেশি নেতা বাগদাদ সফর করতে পেরেছিলেন? না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন যখন যুদ্ধে যায়, তখন তাদের লক্ষ্য থাকে শুধু প্রতিপক্ষের কল্লাকাটা। তারা সবকিছু ধ্বংস করে– যোগাযোগ, পরিবহন, শক্তি, যা সমাজকে কার্যকর রাখে।
সুইডেন ও ফিনল্যান্ড যথাক্রমে ২১০ ও ৭৩ বছর ধরে জোটনিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল। কিন্তু ২০২২ সালের মে মাসে উভয়েই ন্যাটোতে যোগদানের জন্য আবেদন করে। বেশিরভাগ পর্যবেক্ষকের কাছে তাদের অবস্থান পরিবর্তন ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত। আপনি কি মনে করেন?
রুশ আক্রমণের ভয়ের সঙ্গে এ দুই দেশের ন্যাটোতে যোগ দিতে চাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ রাশিয়া এ ধরনের হামলা করতে পারে– তা বর্তমানে কল্পনাতেও নেই। রাশিয়া এ দুই দেশের কাউকে এমনকি হুমকি দিতে পারে বলে যা বলা হচ্ছে, তা ‘পশ্চিমা অপপ্রচার’। ন্যাটোতে যোগদান বরং উভয় নর্ডিক দেশের সামরিক শিল্পকে বিশাল নতুন বাজারের সন্ধান দেয়; তাদের উন্নত সামরিক সরঞ্জামের ভান্ডারে নতুন অ্যাক্সেস দেয়।

ইউক্রেন যুদ্ধের সম্ভাব্য মীমাংসা কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

প্রথমত, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হবে না– এ নিশ্চয়তা দিতে হবে। এটি সেই সীমান্ত রেখা, যা (সাবেক রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট বরিস) ইয়েলৎসিন এবং (সাবেক সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল) গর্বাচেভের পর থেকে প্রত্যেক রাশিয়ান নেতা জোর দিয়ে বলে আসছেন। ভূ-রাজনৈতিক কারণে ইউক্রেন আজ স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার অস্ট্রিয়া বা মেক্সিকোর মর্যাদা লাভ করেছে। মনে রাখবেন, মেক্সিকো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী কোনো সামরিক জোটে যোগ দিতে পারে না। এ বিষয়ে কোনো চুক্তি না থাকলেও এটিই বাস্তবতা। দ্বিতীয়ত, একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে, যেখানে পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলকে একটা নির্দিষ্ট মাত্রার স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। অঞ্চলাটি এখন আংশিকভাবে রাশিয়ার দখলে। তৃতীয়ত, ক্রিমিয়ার বিষয়টি পরে আলোচনা হতে পারে। মিনস্ক-টু চুক্তিতে এ ধরনেরই সমাধান বাতলে দেওয়া আছে। দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যে ২০১৪ ও ’১৫ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মিনস্ক ১ ও ২ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আপনার সমালোচনা শুধু ইউক্রেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাইওয়ান প্রশ্নেও ওয়াশিংটন চীনকে প্রকাশ্যে উস্কানি দিচ্ছে বলে আপনি মনে করেন। এর কারণ বলবেন?

ন্যাটো সম্প্রসারণের মাধ্যমে ওয়াশিংটন যেমন রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু করতে উস্কানি দিয়েছিল, তেমনি তাইওয়ান নিয়েও সে খেলছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে আমেরিকান প্রতিরক্ষা সহযোগিতার দিকে তাকান। পরিষ্কার দেখা যায়, একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ রাষ্ট্রগুলোকে উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত করছে, যেন এরা মার্কিন স্বার্থের পাহারাদার হিসেবে চীনকে ঘিরে একটা বলয় তৈরি করে। এ মুহূর্তে চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কীভাবে, কী হুমকি দিচ্ছে– বলতে পারেন? হুমকি বরং আসছে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এবং ব্রিটেন তা অনুসরণ করছে। যুক্তরাজ্য এই মুহূর্তে শুধু একটা আজ্ঞাবহ রাষ্ট্র। এটা আর স্বাধীন দেশ নয়।

চীন কি একটা স্বশাসিত রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও তাইওয়ানকে হুমকি দিচ্ছে না?

চীন অবশ্যই একটি ইতিবাচক দেশ নয় এবং দক্ষিণ চীন সাগরে সে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। কিন্তু তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে যুদ্ধের আলোচনা পশ্চিম থেকে আসছে; চীন তা বলেনি, যদিও বেইজিং তাইওয়ানকে তার নিজস্ব অঞ্চল হিসেবে দেখে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.