সাম্প্রতিক কালে একাধিকবার সমালোচনা এসেছে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে যে অস্ত্র পাঠিয়েছে, সেটা তাইওয়ানকে দেওয়া উচিত। এই ধারার সমালোচকেরা বলছেন, রাশিয়ার চেয়ে চীন আরও বেশি উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। বেইজিং বল প্রয়োগের মাধ্যমে তাইওয়ান দখলে নিতে চায়, সেই হুমকি অবশ্যই প্রতিরোধ করা উচিত।
তাঁদের এই সমালোচনা অর্ধেক সত্য। হ্যাঁ, তাইওয়ানকে সামরিক দিক থেকে নিজেদের দখলে নেওয়ার চীনের প্রচেষ্টাকে অবশ্যই ঠেকাতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু ইউক্রেনকে যদি পরিত্যাগ করে, তাহলে তাদের সেই প্রচেষ্টাটি খাটো হয়ে যাবে।
তাইওয়ানের এখন অস্ত্রের চেয়েও বেশি দরকার তাদের প্রতি মার্কিনদের সদিচ্ছার প্রদর্শন। চীনকে দেখাতে হবে যে এমন একটি গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র দাঁড়াচ্ছে, যাদের পতন হলে ন্যাটো ও এর পূর্ব এশীয় মিত্র ও মার্কিনদের স্বার্থহানি হবে।
তাইওয়ান ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র পাবে, যেটা তারা আগেও পেয়েছে। ইউক্রেনের মতো তাইওয়ান এখন কারও দ্বারা আক্রান্ত নয়। মার্কিন গোয়েন্দারা বলছেন, ২০২৭ সালে তাইওয়ানে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে চীন। এর অর্থ এই নয় যে ২০২৭ সালে সত্যি সত্যি হামলা করবে চীন।
চার দশক আগে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয় যুক্তরাষ্ট্রের। সে সময় চীন যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছিল, শান্তিপূর্ণ উপায়েই কেবল তাইওয়ানের সঙ্গে তাদের পুনরেকত্রীকরণ হবে, জবরদখলের মাধ্যমে নয়।
১৯৭৯ সালের তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্টে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষার কাজে অস্ত্র দেওয়ার অঙ্গীকার করে। সেখানে বলা আছে, ‘শান্তিপূর্ণ উপায়ের চেয়ে ভিন্ন কোনো উপায়ে কেউ যদি তাইওয়ানের ভাগ্য নির্ধারণ করতে চায়, তাহলে সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয় হবে।’
ওয়াশিংটনের এই অবস্থান অবশ্য এই অঙ্গীকার দেয় না যে তাইওয়ান যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাতে হস্তক্ষেপ করবে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, বিষয়টি বলতে কী বোঝানো হয়েছে, চীন যেন নিজেদের মতো তা অনুমান করে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের তাইওয়ান নীতিতে ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ রয়েছে। চীনকে তারা যেটা বলতে চায়, তার মূল হলো, ‘তাইওয়ানের প্রতিরক্ষায় আমরা আসতেও পারি, না–ও আসতে পারি। তোমরা সেই সুযোগ নেবে কি না, সেটা তোমরা নিজেরাই ভেবে দেখো।’
২০১২ সালে সি চিন পিং চীনের ক্ষমতায় আসার আগপর্যন্ত এই কৌশল কাজ করত। চীনের আগের নেতারা মনে করতেন, তাইওয়ানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলন অনিবার্য এক ঘটনা। এ জন্য তাঁরা অপেক্ষা করতে পারেন। তাঁরা আরও মনে করতেন, সময় তাঁদের পক্ষে।
সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে চীন অধৈর্য হয়ে উঠেছে। তাইওয়ানে সামরিক আগ্রাসনের বিষয়টি এখন চীনা নেতাদের সিদ্ধান্তের বিষয়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি–প্রণেতাদের অনেকে বলছেন, তাইওয়ান ইস্যুতে কৌশলগত অস্পষ্টতা থেকে বের হওয়া উচিত যুক্তরাষ্ট্রের।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন একাধিকবার তাঁর বক্তব্যে কৌশলগত অস্পষ্টতা ভাঙার নজির দেখিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই হোয়াইট হাউস থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের তাইওয়ান নীতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
ইউক্রেনকে সহায়তা করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে এই বার্তা দিতে চেয়েছে যে প্রয়োজনে তার যা যা করা দরকার, তা–ই করবে। লড়াইয়ের ইচ্ছা এবং লড়াই জারি রাখা সামরিক সফলতার মূলমন্ত্র। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত খুব সহজেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়া যায়।
আর কিছু নয়, যে কারণে ভিয়েতনাম যুদ্ধে উত্তর ভিয়েতনাম জিতেছিল, তা হলো যত ত্যাগ স্বীকার করতে হোক না কেন, তারা তাদের লক্ষ্য পূরণে অবিচল থাকবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেটা ছিল না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্যের কাছে জাপানের সামরিক কৌশল ব্যাপকভাবে পরাস্ত হয়েছিল। জাপানিরা ভেবেছিল, প্রশান্ত মহাসাগরের যেসব দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্র জিতে নিয়েছিল, তার প্রতি ইঞ্চি ভূমি থেকে তারা মার্কিনদের উৎখাত করবে। এ জন্য যত মূল্য দিতে হোক না কেন, তার জন্য তারা প্রস্তুত। জাপানিদের সেই পোড়ামাটি নীতি প্রায় সফল হতে বসেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ও নৌপ্রধানেরা নিজেদের বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি যাতে ন্যূনতম পর্যায়ে থাকে, সে জন্য দ্বীপগুলো থেকে পশ্চাদপসারণ শুরু করেছিল। এর মধ্য দিয়ে জনমতকেও ধরে রেখেছিল।
আজকের দিনে, রুশরা অপেক্ষা করছে যাতে ইউক্রেন যুদ্ধে সমর্থন জোগানোর ক্ষেত্রে মার্কিনদের ইচ্ছা কমে যায়। মার্কিনদের অবশ্যই বুঝতে হবে, এটা কেবল ভূখণ্ডগত বিতর্ক নয়। এখানে একটি জাতি বলছে, অন্য জাতির অস্তিত্বেরই কোনো অধিকার নেই। ভ্লাদিমির পুতিনের উদ্দেশ্য হলো একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা। ইউক্রেনে যদি তিনি সফল হন, তাহলে সেখানেই তিনি থামবেন না।
ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি কী হয়, সেটা দেখতে চাইছে চীনারা। আমাদের এশীয় মিত্ররাও সেদিকে তাকিয়ে আছে। পশ্চিমারা যদি ইউক্রেনকে ত্যাগ করে, তাহলে আমাদের এশীয় মিত্রদের অনেকেই চীন শিবিরে যোগ দিতে পারে। অন্যরা পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে চাইতে পারে। এর কোনোটাতেই আমাদের স্বার্থ নেই।
একটি বিষয় বোঝা দরকার যে যুদ্ধ এড়াতে সবাইকে সম্ভাব্য সবকিছুই করতে হবে। একটি আক্রমণ প্রতিহত করার সব প্রস্তুতি তাইওয়ানের নাগরিকদের নিতে হবে। একই সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার মতো প্ররোচনামূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে। তাইওয়ানের মানুষেরা প্রায়ই বলে থাকেন, ‘তাইওয়ান স্বাধীনতার চর্চা করবে, কিন্তু সেটা কখনো প্রচার করা ঠিক হবে না।’
যুক্তরাষ্ট্রের সামনে দুটি করণীয়। কূটনৈতিকভাবে, চীনের সঙ্গে এ ব্যাপারে সম্মত থাকা যে চীন একটাই। একই সঙ্গে স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে তাইওয়ানের বাসিন্দাদের নিরুৎসাহিত করা এবং শান্তিপূর্ণ পুনরেকত্রীকরণের ওপর জোর দেওয়া। সামরিকভাবে নিজেদের অস্ত্র দিয়ে তাইওয়ানকে সজ্জিত করা।
চীন জানে যুক্তরাষ্ট্র কী করছে। তারা জানে প্রতিশ্রুতি হলো শব্দ। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেন থেকে সরে আসে, তাহলে সেটা চীনকে উৎসাহিত করবে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা তাঁর সাম্প্রতিক কিয়েভ সফরে যেমনটা বলেছেন, ‘আজ ইউক্রেন, কাল পূর্ব এশিয়া।’
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
- আরবান সি লেহনার ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাবেক এশিয়াবিষয়ক প্রতিবেদক