শিথিল শর্তে ব্যাংকগুলোই যেন ঋণ পুনঃতপশিল করতে পারে, বিদায়ী বছরেও সেই সুযোগ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ পরিশোধ না করেও নিয়মিত দেখাতে দেওয়া হয়েছে নানা ছাড়। ফলে অনাদায়ী ঋণ নিয়মিত দেখালেও প্রশ্নের মুখে পড়ছে না ব্যাংক। এর পরও খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি বেড়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের
তুলনায় খেলাপি ঋণ ৩৪ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা বেড়ে সেপ্টেম্বর শেষে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা হয়। আর ১৪টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হয় ৩৭ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। খেলাপিসহ ব্যাংক খাতের চাপে থাকা সম্পদ রয়েছে ২৫ শতাংশের বেশি।
বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক ও শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বছরজুড়ে। বেশ আগ থেকে এসব ব্যাংকের সংকট নিয়ে আলোচনা হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পর্যবেক্ষক বা সমন্বয়ক বসিয়ে শুধু দায় সেরেছে। তবে অনিয়মের কারণে আলোচিত ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। সুশাসন ও আর্থিক পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটায় সম্প্রতি ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আরও কয়েকটি ব্যাংক ধারদেনা করে চলছে। উপকরণ ছাড়াই ধার দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে ব্যাংকগুলোকে। নির্বাচনের পর ব্যাংক খাতে সংস্কারের ইঙ্গিত দিয়েছেন গভর্নর।
২০২৩ সালে ডলারের দর ও সুদহার বাজারমুখী করার ক্ষেত্রে দুটি সংস্কার এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত পরিপালনের জন্য যা করা হয়েছে। গত জুলাই থেকে ১৮২দিন ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদের সঙ্গে একটি মার্জিন যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করা হচ্ছে। এ ব্যবস্থায় ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করতে পেরেছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত জুন পর্যন্ত সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ নির্ধারিত ছিল। এ ছাড়া অনেকদিন ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত একটি দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করত। এখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায়ই ডলারের দর ঠিক হচ্ছে। তবে এখন দর বাজারের সঙ্গে মোটামুটি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বছরজুড়ে ডলার আলোচনায় ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দরে ডলার কেনা। বর্তমানে রেমিট্যান্সে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারিত থাকলেও ব্যাংকগুলো ডলার কিনছে ১২০ থেকে ১২২ টাকায়। এ নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে ১০ ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তাদের আবেদনের ফলে শেষ পর্যন্ত জরিমানা মওকুফ হয়েছে। ডলার সংকট চরম আকার ধারণ করায় এবং আইএমএফের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার আলোকে রিজার্ভ সংরক্ষণের জন্য এখন আর দর নিয়ে তেমন প্রশ্ন করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।
আইএমএফের শর্ত মেনে রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে না পারা ও রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির কারণে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কারমুখী উদ্যোগের কারণে আইএমএফ তাতে ছাড় দিয়ে দ্বিতীয় কিস্তি দিয়েছে। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে। তবে ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকের ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে বলা হয়েছে। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি এখন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর চাপে থাকা ঋণের তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি খাতে তেমন ঋণ চাহিদা নেই। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারও এখন ঋণ নিচ্ছে কম। পাশাপাশি বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে চলতি অর্থবছর আমদানি ২১ শতাংশের মতো কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অবশ্য এখন আর আগের মতো বিদেশি ঋণ আসছে না। বরং আগের দেনা পরিশোধে চাপ রয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রির কারণে বাজারে তারল্য কমেছে। আবার মূল্যস্ফীতি বাগে আনতে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া আপাতত বন্ধ আছে। এখন ডলার ও টাকা সংস্থানে হিমশিম খাচ্ছে বেশির ভাগ ব্যাংক। এতে বাজারে সুদহার দ্রুত বাড়ছে। বর্তমানে সরকারের ঋণ ও আন্তঃব্যাংক ধারের সুদহার বেড়ে ১১ শতাংশের ওপরে উঠেছে। এক যুগের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। ব্যাংক খাতের এ সংকট হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়েছে তেমন নয়। ভুয়া প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে অনেকে বেনামি ঋণ বের আর ফেরত দিচ্ছে না। সাধারণভাবে বেনামি ও ভুয়া ঋণই পাচার হয়। ফলে আদায় হয় না।
ব্যাংকের আয়ের প্রধান দুই উৎস সুদ এবং এলসি কমিশন। বছরের মাঝামাঝি সময়ে সুদহারের নতুন ব্যবস্থার কারণে তেমন লাভ করতে পারেনি ব্যাংক। ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমেছে ২১ শতাংশের মতো। মুনাফা করতে এখন গ্রাহকের ওপর বাড়তি চার্জ চাপাচ্ছে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত জুন পর্যন্ত সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল। এর পক্ষেই নানা যুক্তি দিয়ে আসছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের পর কিছু সংস্কার আনা হয়েছে। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে সুদহারের নতুন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। নতুন ব্যবস্থায় প্রতি মাসেই সুদহার একটু করে বাড়ছে।
ওবায়দুল্লাহ রনি