আমাদের গর্বের ‘ছোটু’

0
104
ফারাজ আইয়াজ হোসেন (১৫ এপ্রিল ১৯৯৬—১ জুলাই ২০১৬)

‘আমরা আদর করে ওকে ছোটু বলে ডাকতাম, আর আমার বাবা আবার ওকে ছোটন ডাকত’—কথাগুলো বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে আসছিল ফারাজ হোসেনের মা, বর্তমানে ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও ও এমডি সিমিন রহমানের। এই আদরের নামের সঙ্গে যখন পরিচিত হচ্ছি, তখন আমারও চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে গুলশান টাওয়ারের বোর্ডরুমে বসা সবার সামনে। সিমিন আপা প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছেন যতটা সম্ভব নিজেকে ঠিক রেখে ফারাজ সম্পর্কে যেন ঠিকমতো বলা যায়। নিজেকে কি ঠিক রাখা যায়? মা তাঁর সন্তানের মৃত্যুর গল্প কোনোভাবেই ঠিকমতো বলতে পারেন না, সাহস আর শক্তি অতটুকুই যে তাঁর সন্তান বীরের মতো মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে। আমি তাঁর কথাগুলো শুনে যাচ্ছি আর মনে মনে নোট করে নিচ্ছি যেন গুলশান জঙ্গি হামলায় বন্ধুদের বাঁচাতে গিয়ে আত্মত্যাগ করা ফারাজ হোসেনের গল্প নিয়ে তথ্যচিত্রটি সঠিকভাবে নির্মাণ করতে পারি।

প্রতিবছর প্রথম আলোর বর্ষপূর্তিতে উৎসাহমূলক একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে থাকি। এবারও আনিসুল হক ভাই ডাকলেন, বলছি ২০১৬ সালের কথা, যে বছরের ১ জুলাই গুলশান হোলি আর্টিজান হামলায় নিহত হয়েছেন ফারাজ হোসেনসহ দেশি–বিদেশি মোট ২২ জন। এ ছাড়া ২ জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলেন; আর ৫ জন জঙ্গি। রাত ৯টা ২০ মিনিটে হামলা হয়। মাঝরাতের দিকে জানা গেল, জিম্মি দেশি–বিদেশি সবাইকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। তখনই ফারাজের মায়ের বুকটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। ছোটবেলা থেকেই ফারাজ ন্যায়ের পথে চলা পরোপকারী বন্ধু। বিদেশি বন্ধুদের ছেড়ে ফারাজ চলে আসবে কি না, তা নিয়ে পরিবারের সবাই চিন্তিত। রাত ভোর হয়ে আসে, অজানা আশঙ্কাটাই সত্যি হতে থাকে! নিউইয়র্ক টাইমসের নিউজ বলল, ফারাজকে জঙ্গিরা ছেড়ে দিতে চাইলেও বন্ধুদের ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায়, আত্মাহুতি দিয়ে প্রমাণ করে, বিপদে বন্ধুকে কখনো ছেড়ে যেতে হয় না। এই অনুপ্রেরণাই এবারের প্রথম আলো বর্ষপূর্তির তথ্যচিত্রের বিষয়। প্রথম আলোর সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মতিউর রহমান ডেকে বললেন, ‘একজন নির্মাতা হিসেবে পুরোপুরি স্বাধীনতা আপনার আছে, সব দেখে–শুনে–বুঝে যা মনে হয় নির্মাণ করবেন।’ এ স্বাধীনতার জন্যই প্রতিবছর ডকুমেন্টারি বানানোর অনুপ্রেরণা পাই আমি। এসকেএফের মুজাহিদ ভাইয়ের সহযোগিতায় শুরু হলো আমার ফারাজ সম্পর্কে জানার পালা; কথা বলতে চাইলাম ফারাজের মা ও বড় ভাই যারেফ হোসেনের সঙ্গে। আসলে যতই জানতে শুরু করলাম, ততই অবাক হতে থাকলাম, ওইটুকুন ছোটু কী সাফল্য নিয়ে বড় হচ্ছিল! স্কুল, কলেজ, আন্ডারগ্র্যাজুয়েশন—সব জায়গায় ফারাজ সেরা। কি পড়াশোনায়, কি খেলাধুলায়! বন্ধুদেরও মধ্যমণি।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ফ্যান সে। প্রিয় খেলোয়াড়ের মিনিয়েচার বুকে জড়িয়ে ঘুমায়। নানা ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান জনাব লতিফুর রহমানের আদরের ছোটন সে। এসব শুনতে শুনতে বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, যেন জীবন্ত এক নায়কের গল্প শুনছি, একটু পরেই যার দেখা পাব। কিন্তু জানি, সে আর আমাদের মাঝে নেই! এই নেই মনে হতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, লিখতে পারি না ঘোলা নোটপ্যাডে। শুধুই মনে হয় তরতাজা এক প্রাণ, উচ্ছল এই তারুণ্য কীভাবে চলে গেল, পরিবারের সবাই কী করে থাকবে তাঁকে ছাড়া। ভাবি, কীই–বা নির্মাণ করব, কোত্থেকে শুরু করব! মাথার মধ্যে কোনো ভিজ্যুয়াল খেলা করে না, শুধু ফারাজের বুদ্ধিদীপ্ত হাসিমুখ চোখে ভাসে!

দ্রুত সময় ঘনিয়ে আসে। অবশেষে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিলাম, আসলে কিছু না লিখেই শুরু করব। ফারাজের রুমে যাব, ওর স্মৃতিময় জায়গাগুলোয় দৃশ্য ধারণ করব, এরপর সম্পাদনা করে কিছু একটা দাঁড় করাব। আসলে জানি না কী হবে, শুধু মনের কথাটা শুনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ফারাজের বাসায় যাই, রুমে যাই। বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে। বড় ভাই যারেফ হোসেন ফারাজের সব স্মৃতি সংরক্ষণ করে রেখেছেন পরম মমতায়। একে একে সব দেখান আমাকে। বলতে থাকেন নানান কথা। সব রেকর্ড করতে থাকি আমি। এ বাসাতেই শুরু হয় ফারাজের মায়ের কথাগুলো রেকর্ড করা। সিমিন আপা বলা শুরু করেছেন, পিনপতন নিস্তব্ধতা! সবাই শুনছে আর চোখ মুছছে। তিনি কখনো একজন গর্বিত মা হয়ে কথা বলছেন, আবার কখনো একজন সন্তানহারা অশ্রুসিক্ত মা। কীভাবে যে এই চিত্র ধারণ করেছি জানি না, শুধু জানি, মনের ওপর এত চাপ কখনো অনুভব করিনি। পরদিন শেষ ইন্টারভিউটা নিতে গিয়েছিলাম ফারাজের নানা প্রয়াত লতিফুর রহমান সাহেবের, পাশে ছিলেন যারেফ ভাই। শুরু থেকেই তাঁর আদরের নাতি ছোটন সম্পর্কে কিছু বলতে পারছিলেন না, শুধু চোখ মুছছিলেন। একটা সময় কথা বলা শুরু করলেও বাচ্চাদের মতো কেঁদে ওঠেন, আর সম্ভব হয়নি কিছু রেকর্ড করার।

আমার জীবনে এই প্রথম কোনো নির্মাণে আমি এতটা ইমোশনাল হয়ে পড়ি, শুটিং বা এডিটিং—সব ক্ষেত্রেই বারবারই চোখ ভিজে আসে। কোনোমতে একটা ভার্সন তৈরি করে দেখাতে নিয়ে যাই আনিসুল হককে। তখন প্রথম আলোর কার্যালয় ছিল সিএ ভবনে। আনিস ভাই দেখা শুরু করেন তাঁর রুমে, আমি পাশে দাঁড়ানো। দেখতে দেখতে হঠাৎ বাচ্চাদের মতো ডুকরে কেঁদে ওঠেন, আমি বুঝতে পারছি না কী করব! পাশ থেকে ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমিন আপা ছুটে আসেন। সাজ্জাদ শরিফ, সুমি আপা, আনিস ভাই—সবাই মিলে মতি ভাইকে দেখাতে নিয়ে যাই তাঁর রুমে। তথ্যচিত্র শেষ হতে হতে রুমের পরিবেশ হতে থাকে এক অদ্ভুত আবেগের। আমাদের সবারই কি সেদিন মনে হয়েছিল ফারাজ আমাদের পাশেই আছে?

প্রথম আলোর কর্মী সম্মেলনে প্রথম ‘ছোটু’ প্রদর্শন করা হয়। দেখা শেষে প্রয়াত চেয়ারম্যান শ্রদ্ধেয় লতিফুর রহমান স্যার আমাকে মাথায় হাত দিয়ে যে দোয়া করেছিলেন, তা আমি কোনো দিন ভুলব না।

তারপর ‘ছোটু’ তথ্যচিত্রটি প্রচার করা হয় প্রথম আলোর সোশ্যাল মিডিয়ায়। হাজার হাজার দর্শকের আবেগভরা কমেন্টগুলো আমাকে সব সময়ই মনে করিয়ে দেয়, ফারাজের মতো বীরদের মৃত্যু নেই, ‘ছোটু’রা বেঁচে থাকে মানুষের মনে অনুপ্রেরণা হয়ে।

রেদওয়ান রনি

নির্মাতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.