আমরা যারা ঢাকায় এসে ঘাঁটি গাড়ি

0
115
আঙুলের একটি ছোঁয়ার দূরত্বে থাকা যোগাযোগের যুগেও বাবার খোঁজ কি আমরা নিয়মিত নিই? উল্টো বাবাই ফোন করেন, খবর নেন

ছয় বছর আগে বাবা দিবসের আগে বুধবারের ক্রোড়পত্র অধুনায় ‘সারা বছর কতটা খবর নিই বাবার?’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। উচ্চশিক্ষার জন্য বা পেশাজীবনের জন্য মফস্‌সল থেকে আমরা যারা ঢাকায় এসে ঘাঁটি গাড়ি, জীবন সাজানোর চেষ্টা করি, দূরে থাকা মা–বাবাকে নিয়ে তাদের অনুভূতি কমবেশি একই রকম। যখন মুঠোফোন ছিল না, তখনকার কথা আলাদা—আঙুলের একটি ছোঁয়ার দূরত্বে থাকা যোগাযোগের যুগেও বাবার খোঁজ কি আমরা নিয়মিত নিই? উল্টো বাবাই ফোন করেন, খবর নেন। ‘তুমি তো বাবা খোঁজও নাও না’, বলে শুরু করলেও খোঁজখবর তাঁর উদ্যোগেই হয়। আমরা বলতে থাকি স্নেহ নিম্নগামী, আর বাবা তো বাবাই।

তাই বাবা থাকতে আগ বাড়িয়ে খবর নেওয়া ছেলের জন্য হয়ে ওঠে না। চাইলেও বাবাই এগিয়ে আসেন, এগিয়ে যান। তিনিই আগে ফোনটা করেন। তবে এখন আমি আমার বাবার খবর নিই, খোঁজ করি। মাসে, সপ্তাহে বা দিনে একবার নয়। প্রতিটি ক্ষণে প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিদিন বাবার খোঁজ নিই। প্রায় সাড়ে চার বছর আগে আমার বাবা যেদিন মারা গেলেন, সেই মুহূর্ত থেকেই বাবাকে অনুভব করি, একদম পাশে। দূর আকাশের তারা হয়ে নয়।

আমার ছেলে বা মেয়েকে হাঁক দিয়ে হয়তো ডাকলাম, ‘কিরে, কী করিস?’ আমার কান চকিতে মনে করে অধ্যাপক মুহ. আবদুল মান্নান ডাকছেন। এক সেকেন্ডেই মস্তিষ্ক বলে দেয়, না, তুমিই ডেকেছ। আমার কণ্ঠস্বর আব্বার মতো নয়, টোনটাও এক নয়। তখন মনে পড়ে ভঙ্গিটা এক রকম। আমার ছেলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে যখন ঘুমায়, তখন অবিকল আমার আব্বার মতো লাগে।

আবার রোদে যখন হাঁটি, রাস্তায় আংশিক ছায়া কিংবা লম্বা ছায়াতেও খুঁজে পাই আব্বার ছায়া। তখন বাবার খোঁজ নিই, খবর নিই। ‘আমার সঙ্গেই তো আছ, একই পথে হেঁটে যাচ্ছি। কেমন আছ আব্বা?’ কিন্তু কাছাকাছি হলেও আমার উচ্চতা বাবার উচ্চতা এক নয়। আমার দেহাবয়ব বাবার মতো নয়। তারপরও আমার ছায়াতে আব্বার কায়া যেন ছায়া হয়ে আমার সঙ্গেই থাকে।

কাছের অনেকেই বলেন, আপনি আপনার ছেলেমেয়ের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশেন, এটা খুব ভালো। আমি হাসি। এখানেও আমার কৃতিত্ব নেই। সরিষাবাড়ী কলেজের বাংলার অধ্যাপক আমার বাবা যেখানেই যেতেন সঙ্গে আমাকে নিয়ে যেতেন। ছোট ছোট আঙুল দিয়ে আব্বার বড় বড় আঙুল ধরে থাকতাম আমি। এমনকি ময়মনসিংহ বা জামালপুরে দাপ্তরিক কাজে কিংবা ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষার খাতা সংগ্রহের জন্য যখন যেতেন, তখনো আমি সঙ্গে। কেউ কেউ কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গ করে বলত, ‘স্যারের ভ্যানিটি ব্যাগ।’ আবার আমার স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক মুজিবর রহমান ও ইংরেজির শিক্ষক সুবোধ কুমার রায় বলতেন, ‘এ তো অনেক ভালো অভ্যাস। জওহরলাল নেহরু তাঁর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে সব জায়গায় যেতেন।’

শার্ট পরে বেরিয়ে গেলেন শিমলা বাজারের দিকে। একটু পর এক ঠোঙা চানাচুর নিয়ে এলেন। ‘মিষ্টির দোকান খোলা নেই, তাই চানাচুর আনলাম। পল্লবের মা, কাল খাসির মাংস আনব, রান্না কোরো।’

তো আমি বাবার সান্নিধ্য পেয়েছি আশৈশব। তাই সন্তানদের বেশি সময় দিতে না পারলেও ‘বাবার ছেলে’ হিসেবে ‘অটো সান্নিধ্য’ দিতে চাই বা হয়ে যায়। সেই আমি মাত্র ১৮ বছর বয়সে ছেড়ে আসি মা–বাবাকে। উচ্চশিক্ষার জন্য। এরপর আর কখনো বাড়ি গিয়ে তাঁদের সঙ্গে বেশি দিন থাকা হয়নি। ঈদের সময় হয়তো বাড়তি দু-চার দিন। আমৃত্যু আব্বার ফোনকলে ভেসে এসেছে, ‘কবে আসবি?’ ‘বাবা অনেক দিন আসো না। তোমাকে দেখতেও তো মন চায়।’ আর আমি একটু–আধটু কথা বলে, সময়মতো ইনসুলিন পাঠিয়ে মনে করি দায়িত্ব শেষ।

মুঠোফোনের যুগ আসার পর স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় যোগাযোগ তো হাতের মুঠোয়, তাই সব সময় বুঝি বাড়িতে থাকা বাবার সঙ্গে কথা হবে, খোঁজখবর নেওয়া হবে। কিন্তু আশির দশকের শেষ দিকে যখন ঢাকা আসি, তারও প্রায় এক দশক পর্যন্ত ছিল চিঠির যুগ। তখন ঢাকা-সরিষাবাড়ী চিঠি যেতে–আসতে লাগত ৭ থেকে ১০ দিন। কিন্তু যেদিন চিঠি পেতাম, সেদিন রাতেই ‘প্রিয় আব্বা-মা’ সম্বোধনে চিঠির উত্তর লিখতে বসতাম। পরদিনই ধানমন্ডি ঈদগাহ সাবপোস্ট অফিস কিংবা নিউমার্কেট পোস্ট অফিসে গিয়ে হলুদ খামটা লাল ডাকবাক্সে ফেলতাম। এরপর দ্রুতই চিঠির উত্তর আসত। মানি অর্ডারে টাকা পাঠাতেন আব্বা। মানি অর্ডারের নিচে অল্প একটু জায়গা থাকত কয়েক লাইন লেখার জন্য। সেই জায়গার সদ্ব্যবহারও করতেন। বড় বড় অক্ষরে তিন থেকে চার লাইনে হালকা কুশলাদি, একধরনের মমতার ছোঁয়া বৈষয়িক ব্যাপারেও।
মুঠোফোন আসার পর দেখলাম, খোঁজখবর নেওয়া আগের থেকে যে খুব বেশি হয় তা নয়; দূরালাপ যা, তা সংক্ষেপিত। আসলে সহজ কোনো মাধ্যম যখন হাতের কাছে থাকে, তখন সেটা সহজলভ্যই, মূল্যবান কিছু নয়। চিঠির আমলে তাই বিস্তারিত খবর জানার বা শোনার সুযোগ ছিল।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সব বাবার মতো সন্তানের যেকোনো কিছুতে, তা ছোট হোক বা বড় হোক, আমার বাবাও খুশি হতেন। এসএসসির ফলাফল বেরোল। আমাদের স্কুলে ফলাফল পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। রাত সাড়ে আটটার দিকে ফলাফল পেলাম। তখন গণপরীক্ষায় গণনকলের যুগ। আমাদের এলাকারও বেশ নামডাক তখন এই বিষয়ে। নবম শ্রেণি থেকে টেস্ট পরীক্ষা পর্যন্ত ক্লাসে আমার রোল নম্বর ৩। কিন্তু এসএসসির ফলাফলে দেখা গেল আমার চেয়ে ভালো ফল অন্তত ২০ জন করেছে। লেটার, স্টার মার্কসের ছড়াছড়ি। আমার ১টি লেটার, নম্বর সাকল্যে ৬২৫, প্রথম বিভাগ। ভাবলাম বাসায় গিয়ে কী বলব? আরেকটু ভালো হলে ভালো হতো।

রাত নয়টার বেশি বেজে গেছে, আব্বা শুয়ে পড়েছেন। আমার আওয়াজ পেয়ে উঠলেন, রেজাল্ট কী? বললাম। আব্বা বলেছিলেন, ‘আরে ফার্স্ট ডিভিশন তো? খুব ভালো।’ শার্ট পরে বেরিয়ে গেলেন শিমলা বাজারের দিকে। একটু পর এক ঠোঙা চানাচুর নিয়ে এলেন। ‘মিষ্টির দোকান খোলা নেই, তাই চানাচুর আনলাম। পল্লবের মা, কাল খাসির মাংস আনব, রান্না কোরো।’ সন্তান হয়ে আমরা কি এত অল্পতে খুশি হতে পারি বা পারব?

আব্বা ডাক্তারের কথা মেনে ঠিকঠাক ওষুধ খেতেন। প্রায় ভাত খাওয়ার মতো। আম্মা আবার উল্টো। আমি আম্মার মতো ওষুধের ব্যাপারে। কিন্তু আমার ছেলে অসুস্থ হলে আব্বার মতোই ওষুধ খায়, নিয়ম মেনে চলে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তো আছেই। রক্ত…, ডিএনএ কথা বলে। কিন্তু শুধুই কি বিজ্ঞান? অনুভবের ব্যাপারও আছে। সেটিরও হয়তো বিজ্ঞাননির্ভর ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু কথা হলো, বাবা যখন বেঁচে থাকেন, তখন এমন অনুভূতি হয় না কেন? অবশ্য, ‘বাবা তো আছেই। কাল কথা হবে বা বিকেলে কথা হবে।’ ‘ছুটি পেলেই যাব।’ ‘এই ছুটি হলো না, আচ্ছা ঈদের ছুটিতে তো যাচ্ছি।’ ‘অনেক ব্যস্ততা এখন। একটু সময় পেলেই যাব।’

সাবেক সহকর্মী মেহেদি মাসুদ তাঁর বাবা মারা যাওয়ার কয়েক দিন পর বলেছিলেন, ‘পল্লব, বাবা থাকলে বোঝা যায় না। না থাকলে বোঝা যায়। আংকেলের খোঁজ নিয়েন।’ কিন্তু থাকা অবস্থায় সেই খোঁজ নেওয়া হয় না। পরে আফসোস করাই যেন নিয়তি। এখন প্রতিমুহূর্তেই খোঁজ নিই। খুঁজি আব্বাকে। অনুভব করি পাশে পাশেই আছে। কিন্তু বাবাকে আর খুঁজে পাই না। আর কোনো দিন দেখা হবে না। সম্প্রতি মাকে হারিয়ে আমার খোঁজখবর নেওয়াটা যেন আরও বেড়ে গেল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.