আধখানা প্রেম, আধখানা অপ্রেম

0
89
‘সুড়ঙ্গ’ ছবিতে তমা মির্জা ও আফরান নিশো

লোভ, বিশ্বাসভঙ্গ, বিচ্ছেদ, অপরাধ, হত্যা—সবকিছুর নেপথ্যে একটাই কারণ, টাকা। রায়হান রাফির সুড়ঙ্গর গল্পকে একটা বাক্যে তুলে ধরতে বললে হয়তো এভাবেই বলতে হবে। এটা প্রেম, রোমাঞ্চ, গান, কমেডি, অ্যাকশন, সব মিলিয়ে পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক সিনেমা।

বাণিজ্যিক, তবে মোটেও চেনা ছকে গল্পটা বলেননি রাফি। সুড়ঙ্গকে অনেকেই বলছেন রায়হান রাফির এযাবৎকালের সেরা নির্মাণ। শুধু কি রায়হান রাফি? আফরান নিশো, তমা মির্জা—সবারই অভিনয় জীবনের সেরা কাজ বললে কি খুব বাড়াবাড়ি হবে? গত রোববার রাতে কেরানীগঞ্জের লায়ন সিনেমাসে ‘সুড়ঙ্গ’ দেখা শেষে বাড়ি ফেরার পথে এ কথাই মনে হচ্ছিল।
সিনেমাটি নিয়ে বলার আগে একটি কথা না বলে পারছি না। হলে আক্ষরিক অর্থেই উপচে পড়া ভিড়। শুধু রোববার নয়, ঈদের পর সব কটি দিনই এমন দৃশ্য দেখা গেছে, জানালেন হলসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশ!

বাইরে বৃষ্টি, ভেতরে সুড়ঙ্গ। আমরা লাইন ধরে দ্রুত সুড়ঙ্গ দেখতে ঢুকে যাই। মুক্তির আগে শোনা গেছে, সত্যি ঘটনা অবলম্বনে ছবিটা তৈরি হয়েছে। ওই কাহিনির সঙ্গে কতটা মিল-অমিল, এই নিয়েও অনেক কথা হয়েছে।

এসব শুনে যাঁরা বিশ্বাস করেছেন, তাঁরা ধাক্কা খাবেন। যেমনটা ধাক্কা খেতে হয়েছে বিরতির আগের আর পরের সুড়ঙ্গ দেখে। প্রথমে মনে হয়েছিল, একটা রোমান্টিক সিনেমা দেখছি, পরে মনে হলো থ্রিলার! প্রেম ও অপ্রেমের গল্প। ফিকশন আর নন–ফিকশনকে এমনভাবে মিলিয়েছেন পরিচালক যে কোনটা গল্প আর কোনটা বাস্তব, বোঝা দায়। যেন একটার ভেতর অনেকগুলো সুড়ঙ্গ!

ব্যাপ্তি: ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট
পরিচালক: রায়হান রাফি
প্রযোজনা: আলফা আই স্টুডিও লিমিটেড, চরকি
সিনেমাটোগ্রাফি: সুমন সরকার
চিত্রনাট্য: নাজিম উদ্ দৌলা ও রায়হান রাফী
আবহ সংগীত: আরাফাত মহসিন
শিল্প নির্দেশক: শহীদুল ইসলাম
শব্দ প্রকৌশলী: রিপন নাথ

মূল গল্পে ঢুকতে সময় নিয়েছেন পরিচালক। ধীরে ধীরে প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তবে পুরো সিনেমায় কোনো চরিত্র বা দৃশ্য অতিরিক্ত মনে হয়নি। দর্শকও ক্লান্ত হননি।

হলে আক্ষরিক অর্থেই উপচে পড়া ভিড়
হলে আক্ষরিক অর্থেই উপচে পড়া ভিড়

হলে আক্ষরিক অর্থেই উপচে পড়া ভিড়। শুধু রোববার নয়, ঈদের পর সব কটি দিনই এমন দৃশ্য দেখা গেছে, জানালেন হলসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশ!

সিলেট অঞ্চলের কোনো এক গ্রাম। ছবির মতো সুন্দর সেই গ্রামের তরুণ মাসুদ পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান। ময়নার প্রেমে পড়ে মাসুদ। একসময় তারা বিয়ে করে। সুখের সংসারে হাসিখুশি, সহজ–সরল মাসুদও জটিল হ সংকট তৈরি করে ময়নার উচ্চাভিলাষ। প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে তার চাহিদা। আর এই চাহিদা মেটাতে অল্প আয়ের স্বামীও বদলে যায়। ধীরে ধীরেয়ে যায়। জীবন বদলে দেওয়ার তাগিদে সুড়ঙ্গে নামেন। কীভাবে এই সুড়ঙ্গ মাসুদের জীবন বদলে দেবে?

সংসারের চাওয়া-পাওয়ার কঠিন হিসাব কীভাবে মেলাবে মাসুদ? উচ্চাভিলাষী ময়নার পরিণতি কী? টাকাই কি জীবনের সব? এসব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে সুড়ঙ্গ।

রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশ
রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশ

থ্রিলারলেখক হিসেবে নাজিম উদ্ দৌলার সুনাম আছে। বলতেই হবে, নামের প্রতি যথেষ্ট সুবিচার করেছেন তিনি। গল্পটা বিরতির পর শক্তপোক্ত হতে থাকে, শেষ দৃশ্য পর্যন্ত সতেজ থাকে। সব মিলিয়ে সফল এক বিনোদন সিনেমা সুড়ঙ্গ।

অভিনয়

শুরুতেই বলেছি, এ ছবিতে এ এযাবৎকালের সেরা অভিনয় করেছেন আফরান নিশো। পুরো ছবিতে তাঁর চরিত্রের বেশ কয়েকটি স্তর ছিল, প্রতিটি স্তরে যথাযথ অভিনয় দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। কখনো মজার মজার কথা বলে দর্শকদের হাসাচ্ছেন, কখনো রেগে যাচ্ছেন, আঘাত বা কষ্ট পাওয়ার অভিব্যক্তি নিপুণভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলছেন। বললে বাড়াবাড়ি হবে না যে সংলাপ, অভিব্যক্তি সব মিলে নিশোই এই ছবির ম্যান অব দ্য ম্যাচ।

‘সুড়ঙ্গ’ ছবিতে অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম, আফরান নিশো, তমা মির্জা, মোস্তফা মন্ওয়ার, মনির আহমেদ, অশোক ব্যাপারী প্রমুখ।

 ‘সুড়ঙ্গ’  ছবির গানের দৃশ্যে নুসরাত ফারিয়া
‘সুড়ঙ্গ’ ছবির গানের দৃশ্যে নুসরাত ফারিয়া

তমা মির্জাও নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। ছবিতে তাঁর ভ্রমণটা বেশ কঠিন, চরিত্রটিও জটিল। দর্শকের তালি পাওয়া যতটা কঠিন, গালি খাওয়াও ঠিক ততটাই কঠিন। আরেকজনের অভিনয় নজর কেড়েছে, শহীদুজ্জামান সেলিম। পর্দায় খুব যে বেশি সময় পেয়েছেন, তা নয়। অল্প সময়েই নিজের মেধার ষোলো আনা ঢেলে দিয়েছেন। তাঁর মুখে চট্টগ্রামের ভাষাটাও যথার্থ মনে হয়েছে। মোস্তফা মন্ওয়ারও মনোযোগ কেড়েছেন

আইটেম গানে নুসরাত ফারিয়াকে মনে হয়েছে, টি–টোয়েন্টি ম্যাচে এক ওভার পাওয়া মারকুটে ব্যাটসম্যান, চার–ছয় মেরে ড্রেসিংরুমে ফিরে যান। শিস, তালি দিয়েই উপভোগ করেছেন দর্শক।

কিছু কিছু দৃশ্য বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকের কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা হবে। কালার গ্রেডিংও অনন্য, অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন, যেখানে যতটুকু দরকার ঠিক ততটাই।

নির্মাতা রায়হান রাফি
নির্মাতা রায়হান রাফি

গান ও সংগীত
সুবিশাল একটা স্থাপনা শত চেষ্টা করেও অনেক সময় শতভাগ নিখুঁত হয় না। সুড়ঙ্গর গানের ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটেছে। বলতে গেলে ঠিক সুড়ঙ্গর মতো হয়নি বা দর্শকের কানে লাগেনি। বিশেষ করে বিশাল বাজেটের আইটেম গানে নুসরাত ফারিয়ার দারুণ পারফরম্যান্সের সঙ্গে গানটি দর্শকের ভাষায় ‘টাইট’ হয়নি। অন্যগুলোও দর্শকের মনে থাকবে বলে মনে হয় না, যতটা মনে থেকেছে রাফির পরাণ ছবির গান ‘চল নিরালায়’। এ জায়গায় পরিচালক আরেকটু ভাবতে পারতেন। তবে গল্প আর অভিনয়ে সুড়ঙ্গ এতটাই জমে গেছে যে এ জায়গায় দর্শককে হতাশ হওয়ার সুযোগ দেবে বলে মনে হয় না। এমনিতে গানগুলোর উপস্থিতি সংগতই মনে হয়েছে। নেপথ্য সংগীত সিনেমার সঙ্গে শতভাগ মানানসই।

সিনেমাটোগ্রাফি ও শিল্পনির্দেশনা
ছবির শিল্পনির্দেশনা, কস্টিউম, মেকআপ, আলো প্রশংসা পেতে পারে। সুনামগঞ্জের নীলাদ্রি হোক কিংবা চট্টগ্রামের অসাধারণ সব লোকেশন—পর্দায় দারুণভাবে তুলে এনেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী তরুণ সিনেমাটোগ্রাফার সুমন সরকার। তাঁর অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি সিনেমাটিকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। কিছু কিছু দৃশ্য বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকের কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা হবে। কালার গ্রেডিংও অনন্য, অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন, যেখানে যতটুকু দরকার ঠিক ততটাই।

ফেরার পথে
কানাডাফেরত দর্শক আশিক ইশতিয়াক হকের সঙ্গে কথা হলো। আশিক বলেন, ‘নির্মাণের দিক দিয়ে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র এত দূর এগিয়েছে, সুড়ঙ্গ না দেখলে বুঝতাম না, অসাধারণ!’ রাত ১১টার দিকে যখন সুড়ঙ্গ দেখে বাড়িতে ফিরছিলাম, তখনো লায়ন সিনেমাসের বারান্দা, সামনের রাস্তা মানুষে গিজগিজ করছে। এরা সবাই ‘হলভাঙা মানুষ’, সবার মধ্যে অন্য রকম উচ্ছ্বাস। অনেক দর্শক একজন অভিনয়শিল্পীর নাম ধরে বকা দিচ্ছিলেন, উচিত শিক্ষা হইসে! কার উচিত শিক্ষা হয়েছে, জানার জন্য সুড়ঙ্গ দেখতে হবে। ছবিটি ঢাকার সব কটি মাল্টিপ্লেক্সসহ ২৮টি সিনেমা হলে চলছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.