গরিবের মোটা মসুর ডালের দামও কেজিতে বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। খুচরায় এক কেজি মসুর ডাল কিনতে গুনতে হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১৫ টাকা। একইভাবে মুগ ডালের (মোটা) দামও কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকার বেশি। কিনতে লাগছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। প্রতি কেজি পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। আদার কেজি ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা, রসুন ২০০ টাকার ওপরে। সুবাতাস নেই মসলার বাজারেও। প্রায় সব মসলা পণ্যের দাম বেড়েছে।
সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও অজানা কারণে বাড়ছে দাম। কমার কোনো লক্ষণ নেই। উল্টো দাম বাড়ার তালিকায় প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন ভোগ্যপণ্য। সরকার কয়েকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও এর প্রভাব নেই বাজারে। এতে অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের ভোগ্যপণ্যের সর্ববৃহৎ পাইকারি মোকাম চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, সরবরাহ ও আমদানি স্বাভাবিক থাকার পরও সিন্ডিকেটের কারসাজিতে দাম দফায় দফায় বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে দিশেহারা ভোক্তারা। প্রশাসন শুধু হাতেগোনা কয়েকটি অভিযান চালিয়েই শেষ করছে দায়িত্ব।
খাতুনগঞ্জ ঘুরে প্রায় প্রতিটি আড়তের সামনে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ডাল, ছোলাসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য ভর্তি ট্রাকের সারি দেখা গেছে। খাতুনগঞ্জে প্রধানত হিলি স্থলবন্দর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ ও ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে বেশির ভাগ ভোগ্যপণ্য আসে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও বড় একটি অংশ আসে বৃহৎ এই পাইকারি বাজারে। সরবরাহ অনেকটা স্বাভাবিক থাকায় মালপত্র ওঠানামায় ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে শ্রমিকদেরও।
অর্থনীতির ভাষায় ‘সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে দাম কমবে’– এমন বলা হলেও খাতুনগঞ্জের চিত্র ভিন্ন। গরিব, খেটে খাওয়া হতদরিদ্র মানুষের ভরসার মোটা মসুর ডালের দাম এখন লাগামহীন। পাইকারি মোকামে কয়েক দিন আগেও প্রতি কেজি মসুর ডাল (মোটা) বিক্রি হয়েছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকার ওপরে। মসুর (চিকন) ডালের দামও কেজিতে বেড়েছে প্রায় ১৫ টাকা। বর্তমানে এক কেজি মসুর ডালের দাম পড়ছে ১৩৫ থেকে ১৪৫ টাকা।
স্বস্তি নেই পেঁয়াজের বাজারেও। এক মাস আগে আমদানি করা যেসব পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এখন কিনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। তথ্য বলছে, খাতুনগঞ্জে প্রতিদিন পেঁয়াজ বোঝাই ২৫-৩০টি ট্রাক ঢুকছে, যাকে স্বাভাবিক সরবরাহ বলে দাবি করছেন খোদ ব্যবসায়ীরাও। তবে এর প্রভাব নেই দামে। বর্তমানে ভারতের নাসিক অঞ্চল থেকে আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজ পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা। অথচ কিছুদিন আগেও এ পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। ভারত সরকার গত ১৯ আগস্ট পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এর পর থেকেই অস্থির হয়ে ওঠে পেঁয়াজের বাজার। রাতারাতি খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে যায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ২৪ আগস্ট ভারত ছাড়াও ৯টি দেশ থেকে ১৩ লাখ ৭৩ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। এরই মধ্যে অধিকাংশ পেঁয়াজ বাজারে এসেছে। তবু দাম নাগালের বাইরে।
অস্থির হয়ে উঠেছে আদা, রসুনের বাজারও। খাতুনগঞ্জে আমদানি করা প্রতি কেজি আদা বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়, যা খুচরাতে বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকার ওপরে। একইভাবে পাইকারিতে এক কেজি রসুনের দাম পড়ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, যা খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। সুবাতাস নেই মসলার বাজারেও।
সবচেয়ে বেশি ৩৫০ টাকার ওপরে বেড়েছে এলাচের দাম। কিছুদিন আগে যেসব এলাচ প্রতি কেজি ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, তা এখন ২২৫০ থেকে ২৩০০ টাকা। এ ছাড়া জিরা, গোলমরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গসহ প্রায় মসলার দামই কেজিতে বেড়েছে ৩০ থেকে ৭০ টাকা।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজির কারণে বাজারে এর সুফল মিলছে না। আমদানি ও সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও প্রায় ভোগ্যপণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী। কৃত্রিম সংকট ও সরবরাহে ঘাটতির কথা বলে কারসাজি করে দাম দফায় দফায় বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাচ্ছি আমরা। অভিযান চালিয়ে এর সত্যতাও পেয়েছি। অসাধু ব্যবসায়ীদের এমন আচরণে আমরাও বিব্রত।’
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর-চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক নাসরিন আক্তার বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা সরকার নির্ধারিত দরে পণ্য বিক্রি করছে না। এর বেশকিছু প্রমাণ পেয়েছি আমরা। এ জন্য কয়েকজনকে জরিমানা ও সতর্ক করা হয়েছে। সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে কিছু ব্যবসায়ী। দাম নিয়ে কারসাজি করতে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ক্রয়-বিক্রয়ের রসিদ নিজেদের কাছে রাখছে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে না আসার জন্য এরা অনেকাংশে দায়ী।’
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘ভোগ্যপণ্যের বাজার অসাধু ব্যবসায়ীদের মর্জির ওপর চলছে। বাজারে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ইচ্ছামতো তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। খাতুনগঞ্জের অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে কারসাজি ও সংকট দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়। যেভাবে পণ্যের দাম বাড়ছে, সেভাবে বাজার তদারকি হচ্ছে না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাতুনগঞ্জের এক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘ভোগ্যপণ্যের বাজার ঘিরে সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী চক্র গড়ে উঠেছে। এরা যখন দেখে, পেঁয়াজের বাজার ঊর্ধ্বমুখী তখন সেখানে দৌড়ায়। আবার যখন দেখে ডাল বা মসলার বাজার অস্থির, তখন সেদিকে নজর বাড়িয়ে দেয়। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের এমন আচরণে ভোক্তাদের কপাল পুড়ছে।’
খাতুনগঞ্জের ডাল ও মসলা জাতীয় পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স এমআই ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. ফোরকান বলেন, ‘বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে বলে আমাদেরকেও বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’ কাঁচা পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান কাজী স্টোরের স্বত্বাধিকারী জাবেদ ইকবাল বলেন, ‘কারসাজি করলে স্থলবন্দরের বড় ব্যবসায়ী, আড়তদার ও আমদানিকারকরা করতে পারে। তবে এদের বিরুদ্ধে কখনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।’
শৈবাল আচার্য্য, চট্টগ্রাম