অস্ত্রোপচার কক্ষেও পুরুষ সহকর্মীর কাছে নিরাপদ নন নারী সার্জনরা

0
180
যুক্তরাজ্যের একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার কক্ষ, ফাইল ছবি: রয়টার্স

‘অস্ত্রোপচার কক্ষে তখন অস্ত্রোপচার চলছিল। অনেকেই ছিলেন। কিন্তু আমি ছিলাম সেখানে সর্বকনিষ্ঠ চিকিৎসক। সেই সময় অস্ত্রোপচার করতে করতে একজন জ্যেষ্ঠ পুরুষ সার্জন ঘামছিলেন। আচমকাই তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন এবং আমার বুকে মাথা গুঁজে দিলেন। এরপর তিনি তাঁর ভুরু আমার বুকে ঘষতে লাগলেন। আমি পুরো বরফ হয়ে গেলাম। ভাবলাম, তাঁর মুখ কেন আমার বুকে?

দ্বিতীয়বারও ওই সার্জন এমনটি করলে জুডিথ তাঁকে একটি তোয়ালে দিতে চান। কিন্তু জবাবে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘না না, বরং এটা বেশ মজার।’

জুডিথ বলছিলেন, ‘আমার নিজেকে নোংরা লাগছিল। অপমানিত বোধ করছিলাম। আরও বেশি খারাপ লেগেছিল, অন্য সহকর্মীরা কেউ এ নিয়ে কিছু বললেন না।’

জুডিথ এখন যুক্তরাজ্যের একজন অভিজ্ঞ ও মেধাবী কনসালট্যান্ট–সার্জন। কিন্তু ক্যারিয়ারের প্রথম দিকেই তিনি যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা তাঁর জন্য খুবই অস্বস্তিকর ছিল। তারপরও তিনি বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছেন।

জুডিথ বলেন, ওই চিকিৎসকের চেয়ে বড় কেউ সেখানে ছিলেন না। কিন্তু তিনি (অসদাচরণকারী) জানতেন, এ ধরনের আচরণে কিছু যাবে–আসবে না। অস্ত্রোপচার কক্ষে জুডিথের সঙ্গে এমনটা হয়েছে। হাসপাতালের বাইরে যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা ছিল আরও ব্যাপক।

অ্যানি (ছদ্মনাম) নিজের অভিজ্ঞতা বিবিসির সঙ্গে ভাগ করে নেন। তিনি মনে করেন, ভুক্তভোগীরা মুখ খুললেই পরিবর্তন আসবে। তাঁর সঙ্গে যা হয়েছে, এটিকে তিনি ধর্ষণ বলতে চান না। আবার তাঁর সঙ্গে যা হয়েছে, তা তাঁর সম্মতিতে হয়নি। ঘটনাটি ঘটেছিল একটি সম্মেলনে। সেখানে একই ধরনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা ছিলেন। অ্যানি ছিলেন একজন ট্রেইনি আর ওই ব্যক্তি ছিলেন কনসালট্যান্ট।

অ্যানি বলেন, ‘তাঁর প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল। আর সেই দৃষ্টিতেই আমি তাঁর দিকে তাকিয়েছিলাম। ওই ব্যক্তি এই বিশ্বাসের সুযোগই নিয়েছেন। কারণ, আমি সেখানে কাউকে চিনতাম না। তাই আমি যেখানে উঠেছিলাম, তিনি সেখানে এসেছিলেন। আমি ভাবলাম, তিনি হয়তো আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। হঠাৎ তিনি আমাকে জাপটে ধরে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন।

আমার মাথা কাজ করছিল না, জমে যাই। আমি তাঁকে থামাতে পারছিলাম না। আমি এমনটা কোনো দিন কল্পনাও করিনি, এটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। পরদিন যখন তাঁকে আবার দেখি, আমি কোনোরকমে নিজেকে ধরে রেখেছিলাম।’

অ্যানি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, এ নিয়ে হইচই করে লাভ হবে না। কারণ, আমার সঙ্গে যা হয়েছে, এটি এখানে গা–সহা বিষয় হয়ে গেছে। কিন্তু এ ঘটনা আমার জীবনে দীর্ঘ প্রভাব রেখে গেছে। প্রথমে ওই ঘটনা আমাকে অসাড় করে দিয়েছিল। পরে এটি আমার জীবনে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন হয়ে আসে। কর্মক্ষেত্রে, এমনকি কোনো রোগীকে প্রস্তুত করতে গেলেও এই স্মৃতি আমার মনে হানা দিত।’

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) কর্মীদের ওপর করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাজ্যে অস্ত্রোপচার কক্ষে পুরুষ সার্জনদের হাতে নারী সার্জনরা যৌন হয়রানির শিকার হন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে।

বিবিসি নিউজ এমন হয়রানির শিকার বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলেছে। গবেষকেরা বলেন, জ্যেষ্ঠ পুরুষ সার্জনদের হাতে শিক্ষানবিশ নারী সার্জনদের যৌন হয়রানির একটি ধারা রয়েছে। এনএইচএসের হাসপাতালগুলোয় এখনো এমন হচ্ছে।

ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটার, ইউনিভার্সিটি অব সারে, ওয়ার্কিং পার্টি অব সেক্সুয়াল মিসকন্ডাক্ট ইন সার্জারি (ডব্লিউপিএসএমএস) যৌথভাবে এই গবেষণা করেছে। গবেষকেরা এই গবেষণা প্রতিবেদন বিবিসির সঙ্গে শেয়ার করেছেন।

গবেষণা প্রতিবেদনে যৌন হয়রানি, যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণকে সার্জারির ‘ওপেন সিক্রেট’ বলে উল্লেখ করা হয়। দ্য রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস জানায়, গবেষণায় যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তা ‘সত্যিই বেদনাদায়ক’।

গবেষণায় অংশ নেওয়া নারী সার্জনদের তিন ভাগের প্রায় দুই ভাগই বলেছেন, তাঁদের টার্গেট করে যৌন হয়রানি করা হয়। এক-তৃতীয়াংশ নারী সার্জন জানিয়েছেন, তাঁরা গত পাঁচ বছরে সহকর্মীদের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।

গবেষণায় অংশ নেওয়া নারী সার্জনরা জানান, হয়রানির এ ঘটনা প্রকাশ করলে হয়তো তাঁদের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে। এমনকি এটা জানানোর পর এনএইচএস ব্যবস্থা নেবে—এমন আস্থা ছিল না তাঁদের।

সার্জনদের প্রতি আস্থায় নাড়া পড়েছে

এ ধরনের আচরণের পরও চারপাশের সবাই চুপ থাকবেন—এটাই এখানে অকথিতভাবে স্বীকৃত। অস্ত্রোপচার কক্ষে জ্যেষ্ঠ সার্জনদের কাছ থেকে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নেন শিক্ষানবিশ সার্জনরা। গবেষণায় অংশ নেওয়া নারীরা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী চিকিৎসকদের বিষয়ে মুখ খোলা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

ব্রিটিশ জার্নাল অব সার্জারি এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। নারী সার্জনরা কিসের মধ্য দিয়ে যান, তা বুঝতে এই প্রতিবেদন প্রথম পদক্ষেপ।

গবেষণায় নিবন্ধিত ১ হাজার ৪৩৪ সার্জন অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে অর্ধেকই নারী। এতে বলা হয়, ৬৩ ভাগ নারী জানিয়েছেন, তাঁরা সহকর্মীদের দ্বারা যৌন হয়রানির টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। ৩০ ভাগ নারী জানিয়েছেন, তাঁরা সহকর্মীর হাতে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ১১ ভাগ নারী বলেছেন, ক্যারিয়ারের স্বার্থে তাঁরা বাধ্য হয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। ৯০ ভাগ নারী এবং ৮১ ভাগ পুরুষ যৌন অসদাচরণ স্বচক্ষে দেখেছেন বলে জরিপে স্বীকার করেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষেরাও এ ধরনের নানা হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাঁদের সংখ্যা প্রায় ২৪ শতাংশ। প্রতিবেদনটির শেষ দিকে বলা হয়, নারী ও পুরুষ সার্জনরা ‘ভিন্ন বাস্তবতায় বাস করেন’।

ভুক্তভোগী নারীরা গবেষকদের বলেছেন, ক্যারিয়ারের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় এ বিষয়ে অভিযোগ করার সাহস পাননি তাঁরা। এ ছাড়া অভিযোগ করলেই যে এনএইচএস কোনো ব্যবস্থা নেবে, তাতেও তাঁদের খুব একটা আস্থা ছিল না।

এক্সেটার ইউনিভার্সিটির চিকিৎসক ক্রিস্টোফার বেগেনি বলেন, গবেষণায় উঠে আসা ফলাফল সার্জারি পেশা নিয়ে সাধারণ মানুষের আস্থাকে নাড়িয়ে দিতে পারে।

ইতিমধ্যে ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ নামে দ্বিতীয় আরেকটি প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যসেবা খাতে যৌন অসদাচরণ ঠেকাতে কী করণীয়, সে সম্পর্কে সুপারিশ করা হয়েছে।

দুটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সার্জনদের মধ্যে মাত্র ২৮ শতাংশ নারী। সার্জারিতে অনুক্রম (হিয়ারারকি) খুব গুরুত্বের সঙ্গে মেনে চলা হয়। এতে পুরুষ চিকিৎসকেরা বেশ ক্ষমতাবান থাকেন। এর বাইরে সার্জারি বিভাগে কাজের চাপও অনেক বেশি থাকে।

ইউনিভার্সিটি অব সারের অধ্যাপক ক্যারি নিউল্যান্ড বলেন, এসব কারণে এমন আচরণের পরও পুরুষ চিকিৎসকেরা পার পেয়ে যান। এ কারণে এমন ঘটনা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঘটছে।

এই নারী চিকিৎসক বলেন, জুনিয়র নারী সার্জনরা প্রায়ই পুরুষ সহকর্মীদের হাতে এমন যৌন নির্যাতনের শিকার হন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই পুরুষ সহকর্মী সিনিয়র এবং তাঁদের সুপারভাইজর হয়ে থাকেন। ফলে ভবিষ্যৎ ও ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে চুপ থাকার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক

এ গবেষণায় আরেকটি জিনিস সামনে উঠে এসেছে। আর তা হচ্ছে, এনএইচএস ট্রাস্টস, দ্য জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিল (চিকিৎসকদের অনুশীলন করার জন্য প্রয়োজনীয় নিবন্ধনের বিষয়টি দেখভাল করে) এবং দ্য রয়্যাল কলেজ অব সার্জনসের (মেডিসিনে বিশেষজ্ঞ) প্রতি আস্থাহীনতা।

ইউনিভার্সিটি অব সারের কনসালট্যান্ট সার্জন ক্যারি নিউল্যান্ডস বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবার কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ করে তুলতে আমাদের তদন্তপ্রক্রিয়ায় বড় পরিবর্তন আনা দরকার, যাতে ভুক্তভোগীরা এসব ঘটনা প্রকাশ করতে সাহসী হয়ে উঠতে পারে।’

ইংল্যান্ডের দ্য রয়্যাল কলেজ অব সার্জনসের প্রেসিডেন্ট টিম মিচেল বিবিসিকে বলেন, গবেষণার ফল খুবই বেদনাদায়ক এবং সার্জিকেল পেশার জন্য খুবই বিব্রতকর। তিনি স্বীকার করেন, ‘হরহামেশা ঘটে থাকা এ ধরনের আচরণ’ আগে কখনো আমলে নেওয়া হয়নি।

মিচেল বলেন, কর্মক্ষেত্রে এ ধরনের আচরণের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’–এর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে ভুক্তভোগীরা যাতে তাঁদের সমস্যার কথা বলার মতো পরিবেশ পান, সে আস্থা তৈরি করতে হবে।

এনএইচএস ইংল্যান্ডের চিকিৎসক বিন্তা সুলতান বলেন, এই গবেষণা প্রতিবেদন ‘পড়া সত্যি কঠিন’। হাসপাতালগুলোকে ‘সবার জন্য নিরাপদ’ করতে আরও পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল, প্রতিবেদনে তার ‘স্পষ্ট প্রমাণ’ রয়েছে।

জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিল গত মাসে চিকিৎসকদের পেশাগত মানদণ্ড হালনাগাদ করেছে। কাউন্সিলের প্রধান নির্বাহী চার্লি ম্যাসি বলেন, রোগী বা চিকিৎসক, কারও প্রতি অগ্রহণযোগ্য যৌন আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। একই সঙ্গে যুক্তরাজ্যে চিকিৎসার অনুশীলন চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে এটি বেমানান।

বিবিসি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.