একসময় সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পাথররাজ্যের ‘যুবরাজ’ বলা হতো শামীম আহমদকে। তিনিই নিয়ন্ত্রণ করতেন দেশের প্রধান পাথর কোয়ারি ভোলাগঞ্জ। তবে ৭-৮ বছর আগে নিজেকে গুটিয়ে মন দেন ব্যবসা ও রাজনীতিতে। সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে কোম্পানীগঞ্জের চেয়ারম্যান হয়েছেন তিনি। তবে পাথররাজ্যকে ঘিরে যুবরাজদের আনাগোনা থামেনি। এমনই একজন বিএনপি নেতা মোহাম্মদ আলী। সীমান্ত এলাকায় রয়্যালটির নামে চাঁদাবাজিতে পারঙ্গম কোম্পানীগঞ্জের কাটলবাড়ি গ্রামের মোহাম্মদ আলী আলোচনায় আসেন পাথর তুলে শাহ আরেফিন টিলা ধ্বংসের মধ্য দিয়ে। এই টিলা ধ্বংসের দায়ে তার বিরুদ্ধে আড়াইশ’ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে ক্ষতিপূরণের এ টাকা আদায়ে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
শুধু মোহাম্মদ আলী নন- তার বাবা জিয়াদ আলীও পুলিশ, বিজিবিসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগসাজশে অবৈধভাবে বিভিন্ন স্থান থেকে পাথর তোলেন। পাথররাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে গত কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকা ছাড়াও একাধিক বাড়ি, স্টোন ক্রাশার মেশিন, ফেলুডার, ভলগেট নৌকা ও এক্সক্যাভেটরসহ ৮-১০টি গাড়ির মালিক হয়েছেন মোহাম্মদ আলী।
পাথররাজ্যে বিভিন্ন সময় অরাজকতা, সন্ত্রাস, হত্যা, পরিবেশ ধ্বংস, পাথর লুট ও অভিযানের সময় হামলা চালানোর দায়ে ডজনখানেক মামলা হয়েছে আলীর বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ২৬ মার্চ আরেফিন টিলায় পাথরবাহী ট্রাক্টর থেকে চাঁদা আদায়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশের ওপর হামলা ও ভাংচুর মামলার আসামি হন আলী। এসআই খায়রুল বাশার বাদী হয়ে এ মামলা করেন। এর আগে ১৮ ফেব্রুয়ারি আরেফিন টিলায় বোমা মেশিন উদ্ধার ও পাথর চুরির অভিযোগে মোহাম্মদ আলীসহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা [নং ১৬ (২) ১৯] হয়। এছাড়া জনস্বার্থমূলক মামলায় (নং ৫৮৭৩/২০০৯) তার বিরুদ্ধে রুল জারি করে আরেফিন টিলা কাটার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন উচ্চ আদালত, যা এখনও বলবৎ রয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা বলতে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে কয়েকদিন ধরে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো বক্তব্য দেননি এবং এ বিষয়ে কথা বলতেও রাজি হননি।
আরেফিন টিলা থেকে উৎমা, ভোলাগঞ্জ, বনপুর- সব জায়গায়ই আধিপত্য রয়েছে মোহাম্মদ আলীর। এবার তিনি হাত বাড়িয়েছেন নগরীর মিরের ময়দানের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সচিব সাইফুল ইসলাম চৌধুরীর বাগানের দিকে। উৎমা পাথর কোয়ারির পাশে সীমান্তঘেঁষা বনপুর এলাকার এডিএমের বাগান নামে পরিচিত এ বাগান থেকে গত জুলাই মাস থেকে প্রতিদিন জোর করে লাখ লাখ টাকার পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। আলীকে এ কাজে সহায়তা করছেন স্থানীয় আলী হোসেন, রমজান ও উসমান চক্র।
এরই মধ্যে ১১ জুলাই রাতে শাহ আরেফিন টিলা ধ্বংসের আরেক হোতা, ২০ মামলার আসামি জালিয়ার পাড়ের বশর মিয়াকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে র্যাব-৯। অথচ ৮-১০টি মামলার আসামি হওয়ার পরও মোহাম্মদ আলী এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। থানায়ও অবাধে যাতায়াত করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে থানার ওসি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তবে সম্ভবত তিনি জামিনে আছেন। তারপরও খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়।’
শাহ আরেফিন টিলার নিয়ন্ত্রক বশির অ্যান্ড কোম্পানি, যার মালিক জিয়াদ আলীর ছেলে মোহাম্মদ আলী। বিএনপির আমলে ২০০৪ সালে আরেফিন টিলাভুক্ত মতিয়া টিলার ২৫ হেক্টর ভূমি আবাদের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে ইজারা নেন তিনি। পরে ইজারা বাতিল হলে উচ্চ আদালতে রিট করেন আলী। এই রিটের দোহাই দিয়ে ইজারার বাইরের সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা থেকে কয়েক বছর ধরে পাথর তোলার পাশাপাশি রয়্যালটির নামে ট্রাক্টর ও ট্রাক থেকে তিনি চাঁদা আদায় করে আসছেন। ২০০৯ সাল থেকে এখনও এই টিলা এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছেন তিনি। প্রতি শীত মৌসুমে ১৫-১৬ লাখ ও বর্ষা মৌসুমে ৫-৭ লাখ টাকা ইজারার নামে রয়্যালটি আদায় করে থাকে আলী চক্র।
জিয়াদ আলী ও মোহাম্মদ আলী মিলে আরেফিন টিলা থেকে পাথর উত্তোলন করে সরকারের ২৫১ কোটি ৫০ লাখ ৯০ হাজার টাকার ক্ষতি করেন। ২০০৯ সালের ১১ নভেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) প্রধান করে ক্ষতি নির্ধারণী কমিটি করা হয়। এই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে ১৩৭.৫০ একরের আরেফিন টিলাকে ‘মরা কঙ্কাল’ আখ্যা দেওয়া হয়। পাশাপাশি পাথর উত্তোলন ও পরিবেশ ধ্বংসের জন্য মোহাম্মদ আলীর বশির কোম্পানির কাছ থেকে ২৫১ কোটি ৫০ লাখ ৯০ হাজার টাকা আদায়ের প্রস্তাব করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ওই টাকা সরকারের পাওনা’। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিলেটের পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। কিন্তু এখনও ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করা যায়নি। অভিযোগ উঠেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মামলাটি তামাদি করে রেখেছেন মোহাম্মদ আলী।
উপজেলার আরেক অন্যতম কোয়ারি উৎমা কোয়ারি ইজারা নেন ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান। তবে আজিজুর রহমানের এ লাইসেন্সকে কাজে লাগিয়ে ইজারা নিয়ন্ত্রণ করছেন মোহাম্মদ আলী। ১৯৬৩ সালে জেলা প্রশাসক হিসেবে অবসর নেওয়ার পর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই কোয়ারির পাশে বনপুর মৌজার ২০ একর অকৃষি ভূমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত নিয়ে বাগান করেন। সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ও ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী তার দুই ছেলে। ২০০৫ সালে এ ইজারা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। তবে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে সরকারকে বাগানের ইজারা বাস্তবায়ন ও খাজনা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু এরই মধ্যে সেখানে দৃষ্টি পড়ে তৃতীয় পক্ষের।
পাথরখেকো ও পরিবেশ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বাগানটি রক্ষার জন্য ২২ জুলাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর আত্মীয় সুজা চৌধুরী। এর আগে জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেন ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী। কিন্তু থেমে থাকেনি পাথর উত্তোলন। গত শনিবারও ৭-৮টি গর্তে মেশিন লাগিয়ে পাথর তোলা হয়েছে বলে জানিয়েছে মালিক পক্ষ।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিজেন ব্যানার্জী বলেন, দুটি পৃথক অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে। শিগগির প্রতিবেদন দেওয়া হবে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে একবার অভিযান চালিয়ে কয়েকটি মেশিন ধ্বংস করা হয়েছে। শিগগির আবার অভিযান চালানো হবে।