সংকটেও মন্ত্রী-এমপির সম্পদ বৃদ্ধিতে প্রশ্ন

0
139
রেকর্ড মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকটে

দেশের সার্বিক অর্থনীতির নাজুক অবস্থা। করোনা মহামারির পর ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমেছে। শুধু সাধারণ মানুষ নন, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদেরও হিমশিম দশা। রেকর্ড মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকটে বেশি বিপাকে ফেলেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। ব্যয় সংকোচন নীতিতে চলছে সরকার। অর্থনীতির এমন কঠিন সময়েও এমপি-মন্ত্রী অনেকের আয় ও সম্পদ বেড়েছে কয়েক গুণ। সংকটময় সময়ে রাজনৈতিক নেতারা কীভাবে আরও ধনী হলেন– এই প্রশ্ন উঠেছে জনমনে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতি এখন অর্থনৈতিক লেনদেনে বিশেষ সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার। হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলেও শাস্তির কথা আইনে স্পষ্ট নেই। এরই সুযোগ নিয়েছেন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীরাও।

তাদের হলফনামা বিশ্লেষণেও উঠে এসেছে আর্থিক নানা অসংগতির চিত্র। অবশ্য মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব সম্পর্কিত কোনো অভিযোগ জমা পড়লে সেটা আমলে নিয়ে অনুসন্ধানে নামবে বলে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সাধারণ ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীদের ভাষ্য, তাদের আয় ও সম্পদ কমেছে অর্থনৈতিক সংকটে। সংসার চালানো দায়। সমকালের ফেসবুক পেজে মন্ত্রী-এমপিদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির খবরের শত শত পাঠক মন্তব্য করেছেন। তাদের প্রায় সবার সন্দেহ, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে মন্ত্রী-এমপিদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির গতি মেলে না।

নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া এমপি-মন্ত্রীরা হলফনামায় নিজেরাই আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির তথ্য জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে ‘নির্বাচনী হলফনামার তথ্যচিত্র : জনগণকে কী বার্তা দিচ্ছে?’ শিরোনামে একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)। হলফনামার তুলনামূলক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি আয় বেড়েছে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির– ২ হাজার ১৩১ শতাংশ। অর্থাৎ, পাঁচ বছরের ব্যবধানে মন্ত্রীর বার্ষিক আয় ২১ গুণের বেশি হয়েছে। টিআইবির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ১৫ বছরে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সম্পদ বেড়েছে ৬৩ গুণের বেশি। আরও ১৮ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে রকেট গতিতে। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি ছিল, এমপি-মন্ত্রী এবং সরকারি কর্মকর্তারা বছরে বছরে সম্পদের হিসাব দেবেন; তা বাস্তবায়ন হয়নি। এবারের ইশতেহারে সম্পদের হিসাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নেই।

টিআইবির পরিসংখ্যানকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেছেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। হলফনামায় দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের ৮৭ শতাংশ প্রার্থীই কোটিপতি। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেছেন, গ্রামেও এক কাঠা জমির দাম ২০ লাখ টাকা। পাঁচ কাঠা জমি থাকলেই কোটি টাকার সম্পদ। ঢাকা শহরে এক কোটি টাকার কমে জমি নেই। চট্টগ্রাম শহরেও নেই। এই হিসাব ধরে যদি কোটিপতি ধরা হয়, তাহলে সেই হিসাবে গরমিল আছে এবং তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

অবশ্য মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব সম্পর্কিত কোনো অভিযোগ জমা পড়লে সেটা আমলে নিয়ে অনুসন্ধানে নামবে দুদক। টিআইবির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামার সম্পদের হিসাব ও তাদের অপ্রদর্শিত সম্পদের তথ্য প্রকাশ করার পরদিন দুদক কমিশনার মো. জহুরুল হক সমকালকে এ কথা বলেন। তবে তিনি বলেন, তারা টিআইবির কাছে লিখিতভাবে কোনো তথ্য চাইবে না।

এদিকে, গতকাল বুধবার প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২’-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শহরে দারিদ্র্য কমলেও আর্থিক দুর্বলতা বেড়েছে। মধ্যবিত্তের আয় কমেছে ১০ শতাংশ। কমেছে খাদ্য গ্রহণও। দেশের জনসংখ্যার ২১ দশমিক ১১ শতাংশ মানুষ, অর্থাৎ প্রতি পাঁচজনে একজন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ৫ শতাংশ উচ্চ আয়ের মানুষের হাতে রয়েছে দেশের মোট আয়ের ৩০ শতাংশ। নিম্ন আয়ের ৫০ শতাংশ মানুষের আয় মাত্র ১৮ শতাংশ। ঋণ করে সংসার চালান ৩৭ শতাংশ মানুষ। দেশের মানুষ এমন দুর্দশায় থাকলেও হলফনামা অনুযায়ী মন্ত্রী-এমপিরা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।

যদিও হলফনামা বিশ্লেষণ করা সংস্থাগুলোর ধারণা, এমপি-মন্ত্রীরা আয় ও সম্পদের যে বিবরণী দিয়েছেন, তা হিমশৈলীর চূড়া মাত্র। প্রকৃত হিসাব আসেনি। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের ভাষ্য, বাস্তবে সম্পত্তির পরিমাণ আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মিথ্যা তথ্য দিলে শাস্তির কথা আইনে স্পষ্ট করা নেই। হলফনামা যাচাই করার সক্ষমতা ইসির নেই। ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়ে বিবরণী এনবিআরে পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি।

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক বলেন, রাজনীতি এখন লেনদেনে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার ব্যাপার। আগে রাজনীতি ছিল মূলত নীতি ও আদর্শের। এখন অর্থনৈতিক লেনদেনে বিশেষ সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার। যারা লেনদেনে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন, তাদের সম্পদ ও সম্পত্তি স্বভাবতই বহুলাংশে বেড়েছে। ফলে নিশ্চিতভাবে এটা বলা যায়, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনেও যারা জয়ী হবেন, আগামী পাঁচ বছরে তাদের অনেকের সম্পদও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটাই এখন মূলমন্ত্র। অতএব, জনগণকে এ রাজনীতিবিদদের সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়টি দেখা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার হিসাবে অর্থনৈতিক সংকটে দারিদ্র্য বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ব্যয় বৃদ্ধিতে সঞ্চয় ভেঙে চলছেন বহু মানুষ। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও রাজনৈতিক নেতাদের আয়-সম্পদ বৃদ্ধি স্বাভাবিক নয় বলে মনে করেন নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাট এলাকার পোশাক কারখানার কর্মকর্তা নাহিদুর রহমান খান। সাধারণ এই পেশাজীবী বলেছেন, সংসার চালাতেই হিমশিম দশা। সবার ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থাই কমবেশি খারাপ। রপ্তানি কমে যাওয়ায় এবং আমদানিতে কড়াকড়ির কারণে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরাও সংকটে পড়েছেন। অনেকে প্রতিষ্ঠানের জনবল কমিয়ে ব্যয় সংকোচন করেছেন। একই সময়ে এমপি-মন্ত্রীদের আয়-সম্পদ বৃদ্ধি অস্বাভাবিক।

গত মার্চের হিসাব অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত উৎপাদন আর সেবা খাতের ২০৪ কোম্পানির ১১৯টির ব্যবসা মন্দার দিকে। যারা মুনাফা করছে, তাদের অনেকের লাভ কমেছে। এ পরিসংখ্যানে সাধারণ ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় মন্দার চিত্র এলেও হলফনামা অনুযায়ী এমপি-মন্ত্রীদের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছে। গত বছরের আগস্টে করা জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের জরিপ অনুযায়ী, ৭১ শতাংশ জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে সন্তুষ্ট নয়। ২০০৬ সালে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ (ইজ অব ডুয়িং বিজনেস) র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৫তম। ২০১১ সালে ছিল ১০৭তম। সর্বশেষ র‍্যাঙ্কিংয়ে ১৯০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম, অর্থাৎ ব্যবসা করা কঠিন। কিন্তু হলফনামায় এমপি-মন্ত্রীদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির এ কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের খুব একটা মোকাবিলা করতে হচ্ছে না।

হলফনামায় প্রার্থীরা সম্পদের অর্জনকালীন মূল্য দেন। এ কারণে ঢাকায় ১০ কাঠার প্লটের মূল্য মাত্র ১৬ লাখ টাকা দেখিয়েছেন এক সাবেক মন্ত্রী। আরেকজন ২০ বিঘা জমির দাম দেখিয়েছেন দুই হাজার টাকা। হলফনামায় আয়কর নথিও দিতে হয়। অর্থাৎ যে আয়ের জন্য কর পরিশোধ করা হয়েছে, শুধু তা-ই দেখানো হয়। ফলে অপ্রদর্শিত আয় আসে না নির্বাচনী মাঠের হিসাবে। আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ যে সম্পদ দেখানো হয় রিটার্নে, হলফনামাতেও তা-ই দেখানো হয়। তাই আদালতের আদেশে প্রার্থী তথ্য দিতে বাধ্য হলেও অপ্রদর্শিত আয় ও বেনামি সম্পদের হিসাব আড়ালে থেকে যায়। হলফনামায় দেওয়া আয়-সম্পদের তথ্যের সত্যতা যাচাই করে না নির্বাচন কমিশন। সরকারি অন্যান্য সংস্থাও তা করে না।

দৃশ্যমান ব্যবসা ও পেশা না থাকলেও এমপি-মন্ত্রীদের স্ত্রীদেরও আয়-সম্পদ বৃদ্ধিতে রকেট গতি দেখা যাচ্ছে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে রাজশাহী-৪ আসনের এনামুল হকের স্ত্রী ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের আয় বেড়েছে ৩৮৪ গুণ। বগুড়া-২ আসনের এমপি শরিফুল ইসলাম জিন্নার স্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে ৯৪ গুণ। তিনি ২০০৮ সালে মোটরসাইকেলে চড়তেন। থাকতেন আধাপাকা বাড়িতে। এখন চালান বিলাসবহুল গাড়ি; থাকেন আলিশান বাড়িতে।

হলফনামায় আয়-সম্পদের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তা বৈধভাবে উপার্জিত। টিআইবির ট্রাস্টি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, বৈধ উপায়ে এত সম্পদ মানুষের বাড়ে কিনা, জানি না। তাহলে তো আমরাও বাড়ানোর কিছু চেষ্টা করতাম। কিছু মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা উপার্জন করছে। আর কিছু মানুষ পেট ভরে খাওয়ার জন্য প্রতিদিন যুদ্ধ করছে। একটা অসম সমাজ তৈরি হচ্ছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.