ধানক্ষেতে লবণপানি, কৃষকের চোখে জল

0
115
ধান ক্ষেতে লবনাক্ত পানি।

সবিতা হালদার। সংসারে একটু সচ্ছলতার জন্য গরু বিক্রির ৪০ হাজার টাকা ও এনজিও থেকে ঋণের ৫০ হাজার টাকায় ছয় বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ করেছিলেন। ফলনও বেশ ভালো হওয়ায় আশায় বুক বেঁধেছিলেন, এবার হয়তো বছর ভালো কাটবে। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন নোনাপানিতে ডুবে গেছে।

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার কালেখারবেড় এলাকার সবিতা ধান ঘরে তুলতে মাত্র ১৫ দিন সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীরা চিংড়ি চাষের জন্য খালের বাঁধ কেটে লবণপানি ঢোকানোয় নষ্ট হয়ে গেছে তাঁর কষ্টার্জিত ফসল।

সদর উপজেলার কাশিমপুর এলাকার সুজন শেখ চার বিঘা জমিতে ধান রোপণ করেছিলেন। তাঁর জমি কৃষি বিভাগের সহায়তা পাওয়া ব্লকের মধ্যে ছিল। প্রায় ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ও করেছেন। কৃষি বিভাগের করা সেচ লাইন দিয়ে পানি দিয়েছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে তাঁর জমির ধানও মরে গেছে। নদীতে লবণপানি ঢোকানোয় তা সেচ লাইনেও চলে আসে। এতেই ক্ষতির মুখে পড়েছেন তিনি।

একই চিত্র বাগেরহাটের তিন উপজেলার অন্তত ৪০টি এলাকায়।

একদিকে চাষাবাদের জন্য মিষ্টিপানির অভাব, অন্যদিকে খালে লবণপানি ঢুকিয়ে মাছ চাষ করছেন  প্রভাবশালীরা। এ কারণে গত এক মাসে তিন উপজেলায় অন্তত ১১শ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে, ক্ষতি হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা।

১৫ দিন সময় চেয়ে ইউএনও, স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেও কোনো সুফল পাননি রামপালের কৃষকরা। উপজেলার রাজনগর ইউনিয়নের ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের কালেখারবেড় এলাকার খালের বাঁধ কেটে মাছের ঘেরে পানি ঢুকিয়েছেন জুলু হাজিসহ অন্যরা।  শুধু কালেখারবেড় নয়, উপজেলার রাজনগর ইউনিয়নের সিংগুরবুনিয়া, রনজয়পুর ও আড়ুয়াডঙ্গা এলাকায়ও ঘের ব্যবসায়ীরা খাল কেটে লবণপানি ঢোকানোয় মরতে শুরু করেছে জমির ধান।

সদর উপজেলার ডেমা ও খানপুর ইউনিয়নের অন্তত ৩০০ বিঘা জমির ধান পচে গেছে। ডেমা ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া ও ছবাকি স্লুইস গেট দিয়ে ছবাকি নদীতে লবণপানি ঢোকানোর কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে হাড়িখালীসহ পাশাপাশি তিনটি স্লুইসগেট থেকে পুটিমারী বিলে লবণপানি ঢোকায় স্থানীয় হাড়িখালী ক্ষুদ্র পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি। এতে পুটিমারী বিলের অন্তত ২০০ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে যায়।

মোরেলগঞ্জে কৃষকরা ধান কাটার ২০ দিন আগে একই কায়দায় মাছের ঘেরে লবণপানি তোলার কারণে ৩০০ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। ঘটনার বিচার চেয়ে ২৭ মার্চ ধানক্ষেতের পাশে মানববন্ধনও করেন ভুক্তভোগীরা।

রামপালের কৃষক হুমায়ুন কবির বলেন, হঠাৎ ঘেরে লবণপানি ঢোকাতে খালের বাঁধ কেটে দেন ঘের চাষিরা। বাঁধটি কাটার আগে চেয়ারম্যান, কৃষি কর্মকর্তা ও ইউএনওকে বিষয়টি জানিয়েছেন। ধান কেটে ঘরে তোলার জন্য মাত্র ১৫ দিন সময়ও চেয়েছিলেন। কিন্তু কেউ তাঁদের কথা শোনেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেমা ইউনিয়নের কয়েকজন কৃষক বলেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেনসহ স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছবাকি ও বাঁশবাড়িয়া স্লুইসগেট দিয়ে লবণপানি ঢোকান।

তবে বিষয়টি অস্বীকার করে ডেমা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন দাবি করেন, কৃষকদের সম্মতিতে মাঘী পূর্ণিমার সময় গেট দিয়ে পানি ঢোকানো হয়েছে। কারণ তখন পানি মিষ্টি ছিল। এর পরে আর পানি ঢোকানো হয়নি।

মোরেলগঞ্জ কৃষি কর্মকর্তা আকাশ বৈরাগী বলেন, প্রভাবশালীরা ঘেরে লবণপানি তুলে হতদরিদ্র কৃষকদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে।

রামপালের ইউএনও নাজিবুল আলম বলেন,  ঘের ব্যবসায়ী ও কৃষকদের মাঝে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা সমাধানের জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সদরের ইউএনও রুবাইয়া তাসনিম এসব গেট দিয়ে যাতে লবণপানি ঢোকাতে না পারে, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুম বিল্লাহ বলেন, লবণপানি যাতে ঢুকতে না পারে, সে জন্য তাঁরা গেট বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু রাতে কে বা কারা গেট খুলে লবণ পানি ঢোকান, তা তাঁরা জানেন না। বিষয়টি তাঁরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.