রোববার বিকেলে বালুখালীর আশ্রয়শিবিরের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গার ঘর পুড়ে যায়। স্থানীয় রোহিঙ্গাদের দাবি, আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১১) এ, বি ও ডি ব্লকে একযোগে আগুন লাগায় কয়েকজন রোহিঙ্গা কিশোর। আরসার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা এ সময় ওই কিশোরদের নিরাপত্তা দেয়। আগুন নেভাতে সাধারণ রোহিঙ্গারা ঘটনাস্থলে ছুটে গেলে আরসার ক্যাম্প কমান্ডার নুর হাবির নেতৃত্বে আরসার কয়েকজন গুলি ছুড়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের হটিয়ে দেন।
এদিকে সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে বালুখালী রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৯) নুর হাবিকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত নুর হাবি আরসার বালুখালী ক্যাম্প কমান্ডার ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। তিনি ডাক্তার (পল্লিচিকিৎসক) ওয়াক্কাস নামেও পরিচিত ছিলেন। স্থানীয় রোহিঙ্গাদের দাবি, আগুনের ঘটনায় নুর হাবিসহ আরসার বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী জড়িত ছিলেন। এ কারণে গভীর রাতে নুর হাবিকে তুলে নিয়ে মিয়ানমারের আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) অথবা মাদক চোরাচালানের অন্যতম হোতা নবী হোসেন বাহিনীর সন্ত্রাসীরা হত্যা করতে পারেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত কমিটিকে জবানবন্দি দেওয়া একজন রোহিঙ্গা যুবক বলেন, ‘রোববারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আরসা সরাসরি জড়িত। আমরা রোহিঙ্গাদের ঘরে যাদের আগুন দিতে দেখেছি, তারা আরসার লোক। আরসার ক্যাম্প কমান্ডার ওয়াক্কাস (নুর হাবি), মৌলভি আতাউল্লাহ, সোনা মিয়ার নেতৃত্বে আরসার ২০ থেকে ২৫ জনের সহযোগিতায় কিশোরেরা ক্যাম্পে আগুন দেয়। সাধারণ রোহিঙ্গারা আগুন নেভাতে গেলে আরসা সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়ে কাজে বাধা দেয়। শুরুতে আগুন নেভানো গেলে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।’
জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, রোববারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১১) দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গাদের ঘর পুড়ে গেছে। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি। অগ্নিকাণ্ডে ৯০টির বেশি বেসরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, লার্নিংসেন্টার, ত্রাণকেন্দ্রসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। ক্যাম্প-১১ আশ্রয়শিবিরে ৩২ হাজার ২০০ জন রোহিঙ্গার বাস।
রোববারের অগ্নিকাণ্ডে পুড়েছে ক্যাম্প-১১ আশ্রয়শিবিরের ডি ব্লকের রোহিঙ্গা নেতা আবু তাহেরের ঘর। এরপর স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি অবস্থান নেন পাশের খোলা জায়গায়। আবু তাহের বলেন, চার দিন আগেও আরসার সন্ত্রাসীরা ডি ব্লকে হামলা চালিয়েছিল। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে গিয়েছিল সন্ত্রাসীরা। আরসার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন বলে তাঁকেও বিভিন্ন সময় হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে।
গত দুই দিনে তদন্ত কমিটির সদস্যরা আশ্রয়শিবিরে গিয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন পুলিশ, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার, এপিবিএন, ফায়ার সার্ভিস, গোয়েন্দা সংস্থার একজন করে প্রতিনিধি। তদন্তের অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আমরা সব মহলের সঙ্গে কথা বলছি।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রোহিঙ্গাসহ অন্যদের জবানবন্দি গ্রহণ করেছি। আমরা অন্তত ১০০ জনের বেশি প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি নিতে পারব। অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্য কারণ খোঁজার চেষ্টা করছি। কিছু আলামতও সংগ্রহ হয়েছে। তদন্ত শেষে বলা যাবে, আশ্রয়শিবিরে এই অগ্নিকাণ্ড নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা।’
অগ্নিকাণ্ডে আরসার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রসঙ্গে আবু সুফিয়ান বলেন, ‘এ রকম অনেক কিছু আসছে, ভিডিও দেখেছি। আরও কিছু আছে। তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে এ নিয়ে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির আরেক সদস্য বলেন, তদন্ত কমিটির কাছে একাধিক রোহিঙ্গা রোববারের ঘটনাকে নাশকতা বলে দাবি করেন। এ ঘটনার জন্য রোহিঙ্গারা আরসাকে অভিযুক্ত করছে। প্রাথমিক তদন্তেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আরসার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। কয়েকটি ঘরে আগুন লাগানোর ভিডিও চিত্রও সংগ্রহ করেছে কমিটি।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে আশ্রয়শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২২২টি। এর মধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত ও ৬০টি নাশকতামূলক। এ ছাড়া ৬৩টির কোনো কারণ জানা যায়নি।