যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত বাংলাদেশের কাছে কী চায়

0
235
ভারত বাংলাদেশের কাছে কী চায়

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি এবং তার সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে এরই মধ্যে অনেক লেখালেখি হয়েছে। মুখে যে যা-ই বলুক, সব পক্ষই যে বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ভিসা নীতি কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই।

ক্ষমতার বলয়ের অন্তর্গত বিভিন্ন পর্যায়ের বিপুলসংখ্যক মানুষের পাচার করা অর্থসম্পদ, বাড়িঘর এবং তাঁদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের বড় অংশই যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া তাঁদের জন্য দুরূহ। মার্কিন পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে একটি চাপ সৃষ্টির প্রয়াস। এর আগে গণতন্ত্র সম্মেলনে নিমন্ত্রণ না করা এবং র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, আর এরপর দুই দফায় ১২ জন কংগ্রেসম্যানের চিঠি—সবই একই প্রক্রিয়ার অংশ।

আপাতদৃষ্টে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উদ্ভূত এই পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশে সুষ্ঠু এবং অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে বলেই প্রতিভাত হয়। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অঙ্গীকারের সঙ্গেও তা সামঞ্জস্যপূর্ণ।

তবে বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীতে আরও দেশ আছে, যেখানে হাইব্রিড শাসন বা স্বৈরাচারী সরকার রয়েছে। সেসব দেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এমন দৃঢ় প্রত্যয় পরিলক্ষিত হয় না। গণতন্ত্রের পাশাপাশি তাই যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে আঞ্চলিক ভূরাজনীতি। বাংলাদেশ ঘিরে যে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক খেলা চলছে, তাতে জড়িত তিনটি বৃহৎ শক্তি—যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত। এদের কার কী চাওয়া, সেদিকে খানিকটা দৃষ্টি দেওয়া যাক।

ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিকসহ নানা কারণে গত বছরগুলোয় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই চায় যে বাংলাদেশ চীনের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসুক। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক রণকৌশল এবং কোয়াড সংগঠন চীনের প্রভাবকে সীমিত করার লক্ষ্যেই সৃষ্ট। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শেষ সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাংলাদেশ এই রণকৌশলে যুক্ত হোক। বাইডেন আমলেও এই প্রয়াস অব্যাহত।

নির্বাচনের এখনো মাস ছয়েক বাকি। আঞ্চলিক ভূরাজনীতির তিন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের হাতে আর কী কী তাস আছে, কী কী পদক্ষেপ তারা নিতে পারে বা নেয়, তার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করবে কোন পথে যাবে বাংলাদেশ। এ অনিশ্চয়তার চট করে অবসান হবে, এমন সম্ভাবনা কম। এখন শুধু পর্যবেক্ষণ আর অপেক্ষার পালা।

সংগত কারণেই বাংলাদেশ চীনবিরোধী একটি জোটে শরিক হতে আগ্রহী হয়নি। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের অযৌক্তিক দাবির বিষয়েও বাংলাদেশ বরাবর নীরব থেকেছে। অন্যদিকে গত ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশ যে ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক ঘোষণা করেছে, তার সঙ্গে মার্কিন রণকৌশল সাংঘর্ষিক নয়। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক জাপান সফর শেষে ২৬ এপ্রিল ঘোষিত যৌথ ইশতেহারেও তার প্রতিফলন আছে। এতে সমুদ্রসীমার বিষয়ে বাংলাদেশ আনক্লসের সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে, যা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাবির বিরুদ্ধে যায়। উভয় পক্ষের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষার যে প্রয়াস বাংলাদেশ করে আসছে, এতে তাই প্রতিফলিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টতই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরও বেশি সহযোগিতা প্রত্যাশা করে। বাংলাদেশে একটি মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে—এমন প্রত্যাশা যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভবত রয়েছে। ভিসা নীতি থেকে শুরু করে কংগ্রেস সদস্যদের চিঠির মধ্যমে বাংলাদেশের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার কৌশল সে কারণেই নিয়ে থাকতে পারে।

এ প্রসঙ্গে চীনের অবস্থান সে তুলনায় অনেক সরল। বাংলাদেশের নির্বাচন দিনে হলো না রাতে, চীনের তাতে কিছু যায় আসে না। গত ১৫ বছরে চীন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেকটা জাঁকিয়ে বসতে সক্ষম হয়েছে। চীন বাংলাদেশের পণ্য আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস। বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বাণিজ্যিক সুদে প্রচুর লগ্নি করেছে চীন। আবার অতিমূল্যায়িত অধিকাংশ মেগা প্রকল্পে ঠিকাদারি করে চীনা কোম্পানিগুলো বিপুল মুনাফা অর্জন করছে। অন্যদিকে সীমান্ত এবং ভারত মহাসাগরে আধিপত্য নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান।

বাস্তববাদী চীন অবশ্যই প্রত্যাশা করে না যে ভূগোলকে অস্বীকার করে বাংলাদেশ কোনো সংঘাতে ভারতকে বাদ দিয়ে তার পক্ষ নেবে। চীনের প্রত্যাশা এই তিন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতা। বর্তমান সরকার এ প্রত্যাশা পূরণ করছে এবং তাদের ক্ষমতায় থেকে যাওয়া চীনের স্বার্থের অনুকূল।

নিষেধাজ্ঞা, ভিসা নীতিসহ যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ অনমনীয় অবস্থান নিয়েছেন। ১৪ জুন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শেখ হাসিনার অবস্থানকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন এবং মার্কিন আধিপত্যবাদের তীব্র সমালোচনা করেন।

চীনের তুলনায় ভারতের সমীকরণ অনেক বেশি জটিল। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্রের পশ্চাদযাত্রায়’ বৃহত্তম গণতন্ত্রের দাবিদার ভারতের ভূমিকায় বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে। সেটাকে বাদ দিলেও ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র চলমান দ্বৈরথে ভারতের অভিন্ন স্বার্থ আছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। অথচ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে চাওয়া (মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন), তার সঙ্গে সুর মেলাতে পারছে না ভারত।

যেকোনো বিচারেই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন থাকা ভারতের জন্য কাম্য ও সুবিধাজনক। তাই ২০১৪ বা ২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন নিয়ে ভারত কোনো মন্তব্য তো করেইনি, বরং তাতে সহায়তা করেছে বলেই অভিযোগ আছে। ভারত স্বভাবতই চাইবে আগামী নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় থাকুক, আর তারা জানে যে সে জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত আছে। এ ক্ষেত্রে মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের এই বাগড়া তাই ভারতের জন্য একটি উপদ্রব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত তার অনেক দিনের নীরবতা সম্প্রতি ভেঙেছে। ৯ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সাংবাদিকদের বলেছেন, ভারত মনে করে বিদেশি কিছু রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। এরপর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বলেছেন, ভারত আশা করে, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যাতে ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করবেন। সেখানে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর পাশাপাশি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন চাপ প্রসঙ্গেও আলোচনা হতে পারে। স্পষ্টতই ভারত চাইছে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগে যুক্তরাষ্ট্র বিরত থাকুক। দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যার মতোই, নির্বাচন নিয়েও চিরশত্রু ভারত ও চীনের স্বার্থ অনেকটাই এক হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা অবিরাম বলে যাচ্ছেন যে বর্তমান সরকারের অধীন আগামী নির্বাচন হবে অবাধ ও স্বচ্ছ এবং জনগণ স্বাধীনভাবে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেভাবেই হবে।

কিন্তু সমস্যা হলো, সাধারণ জনগণ এবং প্রকৃত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কেউই আশ্বস্ত হতে পারছে না যে আগামী নির্বাচনটি ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো হবে না। আলোচনা বা আইন পরিবর্তন—যেভাবেই হোক এ বিশ্বাসটুকু ফিরিয়ে আনতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু কাজটা সহজ নয়, আর সরকার কেনই–বা তা করবে, যেখানে নির্বাচনে নিশ্চিত বিজয় অর্জনের একটি ব্যবস্থা বিদ্যমান আছে।

নির্বাচনের এখনো মাস ছয়েক বাকি। আঞ্চলিক ভূরাজনীতির তিন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের হাতে আর কী কী তাস আছে, কী কী পদক্ষেপ তারা নিতে পারে বা নেয়, তার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করবে কোন পথে যাবে বাংলাদেশ। এ অনিশ্চয়তার চট করে অবসান হবে, এমন সম্ভাবনা কম। এখন শুধু পর্যবেক্ষণ আর অপেক্ষার পালা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.