‘যদি ভালোবাসা পাই আবার শুধরে নেবো ভুলগুলি’

0
173
ভ্যালেন্টাইন্স ডে

ভ্যালেন্টাইন্স ডে তথা ভালোবাসা দিবস ঘিরে অথবা ভালোবাসা বা প্রেম প্রত্যয়টি মাথায় রেখে ইতোমধ্যেই আমাদের কবিকুল সৃষ্টি করে চলেছেন নতুন নতুন সব কবিতা। এর মধ্যে বহুল উচ্চারিত রফিক আজাদের কবিতা: ‘যদি ভালোবাসা পাই/ আবার শুধরে নেবো ভুলগুলি’। শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো/যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব।’

ভালোবাসা দিবস যেন ফুল ফোটার দিন। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘ফুলের ফসল’ কবিতায় বলছেন:’জোটে যদি মোটে একটি পয়সা/ খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি’/ দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার/ ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী।’ আর কবি জসীম উদ্‌দীন বলছেন: ‘ফুল নেয়া ভাল নয় মেয়ে।/ ফুল নিলে ফুল দিতে হয়,/ ফুলের মতন প্রাণ দিতে হয়।’ প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে আজও গভীর অনুরণন সৃষ্টি করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন: ‘ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি/ দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়/ বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীলপদ্ম/ তবু কথা রাখেনি বরুণা।’

ভ্যালেন্টাইন্স ডে তথা ভ্যালেন্টাইন দিবস, খ্রিষ্টান ও প্রাচীন রোমান- উভয় ঐতিহ্যেরই স্মারক। ক্যাথলিক চার্চ ভ্যালেন্টাইন নামে অন্তত তিনজন সাধুর অস্তিত্ব স্বীকার করে, যাঁদের সবাই শহীদ হয়েছেন। কথিত আছে, সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস ভাবতেন, যে সব সৈনিকের স্ত্রী বা ফ্যামিলি নেই, তারা যোদ্ধা হিসেবে ভালো হয়। এই চিন্তা থেকে তিনি যুবকদের বিবাহ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। সাধু ভ্যালেন্টাইন এ অধ্যাদেশকে অন্যায় বলে গণ্য করেন এবং তরুণ প্রেমিক-প্রেমিকাদের গোপনে বিবাহ পড়ানোর কাজ চালিয়ে যান। ক্রুদ্ধ ক্লডিয়াস সাধু ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দেন ও কার্যকর করেন। আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, রোমান কারাগার থেকে খ্রিষ্টান বন্দিদের পালাতে সাহায্য করার জন্য সাধু ভ্যালেন্টাইনকে হত্যা করা হয়। এরকম গল্পও প্রচলিত আছে যে, বন্দি ভ্যালেন্টাইন কারাধ্যক্ষের অল্প বয়সী কন্যার প্রেমে পড়ে গোপনে দেখা করতেন এবং একবার সেই মেয়েটিকে লেখা ‘তোমার ভ্যালেন্টাইনের কাছ থেকে’ সংবলিত শুভেচ্ছা বার্তা ধরা পড়ে। এই অপরাধে সাধু ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এর মধ্যে কোন গল্পটা সত্য, বলা মুশকিল। তবে সব গল্পই সাধু ভ্যালেন্টাইনের ভালোবাসা, বীরত্ব ও রোমান্টিক তথা কল্পণা-রঙীন ব্যক্তিত্বের কথা জানান দেয়।

সাধু ভ্যালেন্টাইনকে হত্যার ঘটনাটি ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে ঘটেছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। পুরো ফেব্রুয়ারি মাসটিকেই তাই রোমান্সের তথা কল্পনা-রঙিন মাস হিসেবে তামাম দুনিয়ার সব প্রেমিক-প্রেমিকা পালন করে আসছে। কাকতালীয়ভাবে ১৪ ফেব্রুয়ারি বা একদিন আগে-পরে বাঙালির পহেলা ফাল্কগ্দুন অর্থাৎ মধু মাসের প্রথম দিন তথা বাংলা ঋতু, বসন্তকালের প্রথম দিন। পহেলা ফাল্কগ্দুনও বাঙালির একটি কল্পনা-রঙিন তথা ভালোবাসা বা প্রেম আদান-প্রদানের দিন, ফুলের দিন, ফলের দিন, মিষ্টিমুখের দিন, গল্পের দিন, গানের দিন, কবিতার দিন, উৎসবের দিন, সাজবার ও সাজাবার দিন।

বহুদিন ধরে একটি বিতর্ক চলে আসছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে তথা ভ্যালেন্টাইন দিবস ঘিরে। ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপন পশ্চিম দুনিয়ার সংস্কৃতি হতে পারে, আমাদের তো নয়। তবে আমরা কেন এটা উদযাপন করব? ভাষার মতো সংস্কৃতিও বহমান নদীর মতো, সমুদ্রের জলের মতো। যে কোনো ভূখণ্ডের সংস্কৃতিই জন্ম থেকে সতত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। অন্যান্য সংস্কৃতি থেকে সে নিজের মধ্যে উপাদান সংগ্রহ করে ঋদ্ধ হয় আবার বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতির ফলে নিজের কিছু কিছু উপাদান বর্জন করে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যে ১০৬ নম্বর কবিতাংশে আর্য, অনার্য, ইংরাজ, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান- সবাইকে ভারতসাগর তীরে এসে দাঁড়াতে আহ্বান জানিয়েছেন। আবার বলছেন,

‘পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার,

সেথা হতে সবে আনে উপহার,

দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে

যাবে না ফিরে’

তার মানে হলো, প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির আদান-প্রদানের একটি সেতুবন্ধ স্থাপন করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন, এই লক্ষ্যে কাজও করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন, ঋষি অরবিন্দ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশ বসু, সত্যেন বোস, মেঘনাথ সাহা, কাজী নজরুল ইসলাম- এমনকি স্বামী বিবেকানন্দ, যাঁর গভীর বিশ্বাস ছিল বেদ, বেদান্ত ও উপনিষদে।

একান্ত নিজস্ব এবং হৃদয়ের নিবিড় গভীরের যে ধন, সম্পদ এবং সংস্কৃতি, জাতীয়তা, ঐতিহ্য ঘিরে যে দিন, ক্ষণ- সব কিছুকে মূল্য দিয়েও শুধু পশ্চিম নয়, পূর্ব, দক্ষিণ, উত্তর- সব সংস্কৃতিরই শুভ, মঙ্গলকর ও ভালোর দিকগুলো গ্রহণ করাই আধুনিকতার লক্ষণ। এই ফেব্রুয়ারি মাসেই বাঙালির ভাষা আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ সেলিম ও দেলোয়ার, পহেলা ফাল্কগ্দুন- সব কিছুর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় ভ্যালেন্টাইন্স ডে তথা ভালোবাসা দিবস, সাধু ভ্যালেন্টাইনের মতো আত্মত্যাগ, বীরত্ব ও ভালোবাসার গল্প যদি যুক্ত হয় আমাদের সংস্কৃতিতেও, মন্দ কী?

বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে কিছু হিন্দুয়ানি উপাদান আছে বলে অনেকে আভিযোগ উত্থাপন করেন। মনে রাখতে হবে, মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই সংস্কৃতি। ধর্মের আবির্ভাব অনেক পরে। অ্যারিস্টটল তাঁর ‘পলিটিপ’ বইয়ে যখন বলেন, ‘ম্যান ইজ অরিজিনালি অ্যানিম্যাল’ অথবা ‘ম্যান ইজ বাই নেইচার আ সোশ্যাল অ্যানিম্যাল’, তখন আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে যায় যে, মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য হলো সংস্কৃতি অর্থাৎ মানুষের সংস্কৃতি আছে আর পশুর কোনো সংস্কৃতি নেই। সংস্কৃতির আয়ু মনুষ্য প্রজাতির আয়ুর সমান; কিন্তু ধর্মের আয়ু মনুষ্য প্রজাতির আয়ুর সমান নয়।

ড. আহমদ শরীফ তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ‘বাঙলা, বাঙালী ও বাঙালীত্ব’-এ জানাচ্ছেন, ‘বাঙালী সংস্কৃতির উৎস ও ভিত্তি ছিল অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-মঙ্গোলীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান তত্ত্ব ও মনন… সর্বপ্রাণবাদে তথা জড়বাদে এবং জাদুতে তাঁর আস্থাও অবচেতন ও নিঃসঙ্গ মনে ক্রিয়াশীল থেকেছে চিরকাল। বৃক্ষ দেবতা, নারী দেবতা, পশু-পাখি দেবতা, দেহচর্যা ও জন্মান্তরে বিশ্বাস তাদেরই সৃষ্টি।’ তিনি লিখেছেন, ‘জৈন-বৌদ্ধ-বাহ্মণ্য-খ্রিষ্ট ধর্ম এবং ইসলাম গ্রহণ করেও বাঙালী তার আদিম ঐতিহ্য কখনও সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে পারেনি। তাই গাছের মধ্যে বট, অশ্বত্থ, তাল, তেঁতুল, তুলসী প্রভৃতি, পাখির মধ্যে কাক, পেচক (পেঁচা), শকুন, শালিক প্রভৃতি… বাঙালীর চেতনায়, রোগের চিকিৎসায়, শুভাশুভ চিন্তায় এবং সিদ্দি-সাফল্য কামনায় আজো উপযোগ হারায়নি।’ আজ যখন একটি মহল মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্যাঁচার ছবি ব্যবহারে আপত্তি জানায়, তখন বুঝতে আসুবিধা হয় না, এটা গভীর অজ্ঞতাপ্রসূত। কারণ তাঁরা জানেন না, এটা কোনো ধর্মের উপাদান নয়, বরং সংস্কৃতির উপাদান। যখন মৌলবাদীরা হিন্দুত্বের ধুয়া তুলে বাঙালির সংস্কৃতি চর্চায় বাধা দেন, তখন বুঝতে আসুবিধা হয় না যে, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যই তাঁরা এটা করেন। সত্য হলো, সংস্কৃতি চর্চা ও ধর্ম পালন যদি পাশাপাশি চলে, তাহলেই কল্যাণ সর্বাধিক হবে সমষ্টির জীবনে।

ড. এন এন তরুণ: ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ

বেবী সাউ: রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.