ভারতে আতিক হত্যাকাণ্ড যে প্রশ্নের জন্ম দিল

0
197

মাফিয়া কো মিট্টি মিলা দেঙ্গে…’ (মাফিয়াদের মাটিতে গুঁড়িয়ে দেব) গত ২৪ ফেব্রুয়ারি উমেশ পালের হত্যাকাণ্ডের পর উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের এ বিবৃতি অনর্থক ছিল না। এ খুনের সঙ্গে গত ১৫ এপ্রিল এনকাউন্টারে নিহত আতিক আহমেদের নাম জড়িয়ে ছিল। প্রধানমন্ত্রী মোদির সম্ভাব্য উত্তরসূরির এই বিবৃতিই বলছে, রাষ্ট্রে কতটা বিচারহীনতা চলছে। ওই ঘটনার সন্দেহভাজন আরেক খুনি আতিকের ছেলেও কয়েক দিন আগে এনকাউন্টারে নিহত হয়। এরপর আতিক এবং তাঁর ভাই আশরাফকে অজ্ঞাত হামলাকারীরা সরাসরি হত্যা করে এবং এতে পুলিশ নীরব দর্শকের আচরণ করে। অপরাধীদের নির্মূল করার পরিবর্তে এই নির্লজ্জ কাজ রাজ্যে অনাচারকেই আরও জোরদার করেছে। এটি উত্তর প্রদেশের জাতীয় ভাবমূর্তির ক্ষতি করছে।

আতিকের খুনকে বাইরে থেকে যা  মনে হচ্ছে, ভেতরে তার চেয়ে বেশি কিছু রয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে যোগীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা এক সুতোয় আটকে গেছে।

আতিক ও আশরাফ দুই ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে। উত্তর প্রদেশের পুলিশ এবং রাজ্য প্রশাসনের অত্যন্ত দায়িত্বহীন ভূমিকা দেখা গেছে। টুইটার ব্যবহারকারী এবং দেশটির একটি অংশ ভয়ংকর এক দুর্বৃত্তের নির্মম ও প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ডে আনন্দিত হতে পারে; তারা একে ‘ন্যায়সংগত’ বলে রাষ্ট্রকেও সমর্থন করতে পারে। কিন্তু এটি পুলিশি হেফাজতে যে কারও সুরক্ষা পাওয়ার সংবিধানস্বীকৃত অধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এহেন হত্যাকাণ্ড প্রশাসনিক দায়িত্বহীনতার পরিচয়বাহী; যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন সরকারকে অবশ্যই এ জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এই অবহেলার বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য। নয়তো রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে তিনি যে বিস্তর উন্নতির দাবি করে আসছেন, তা মিথ্যা বলে প্রমাণ হবে। এই হত্যাকাণ্ডে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা যে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন, তা উপেক্ষা করা অসম্ভব। গত দশকে আমাদের সমাজে যে মেরূকরণ হয়েছে, এখানে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।

আতিক হত্যাকাণ্ড ‘সংগঠিত অপরাধ’-এর একটি উদাহরণ মাত্র। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ইতোমধ্যে তাঁর বাসভবনে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করার পর তিন সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিটির মাধ্যমে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এটি হিমশৈলের চূড়ামাত্র এবং তার মধ্যে একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্র কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সে জন্য প্রশাসনকে অবশ্যই এ তদন্তে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অপরাধী এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যকার সম্পর্ক এক ধরনের এজেন্ডা চালানোর জন্য ব্যবহার হয়। সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি বা ভারতীয় জনতা পার্টি– সবাই এ ব্যবস্থার ওপর ভরসা করছে। তা সত্ত্বেও কয়েকটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ: আততায়ীরা কীভাবে জানত যে কখন ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে? সব পূর্বনির্ধারিত বলে মনে হচ্ছে। নিরাপত্তা এতটা ঢিলেঢালা ছিল যে, তারা ক্যামেরা এবং পুলিশের সামনে আতিক ও আশরাফকে গুলি করেছে?

আতিক হত্যার ঘটনাটি ভারতের ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। এটি সংখ্যালঘু ভোটকে সমাজবাদী পার্টির পক্ষে টানতে পারে। ২০০৪ সালে আতিক ফুলপুর থেকে সমাজবাদী পার্টির টিকিটে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতেছিলেন। এই আসনটিতে একসময় জওহরলাল নেহরু প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। অন্যদিকে কট্টর হিন্দুদের ভোট বিজেপির সঙ্গেই থাকে। বিজেপি গত বছরের অক্টোবরে লক্ষ্ণৌতে পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয় সদস্য এবং বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক স্থাপনের জন্য একটি সম্মেলন করেছিল।
ভাসমান ভোটারদের হিসাবনিকাশে এ ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এরও দুটি মাত্রা আছে। যদিও অনেকে মনে করেন, শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচারের জয় হয়েছে এবং আতিক এই মৃত্যুর মাধ্যমে তাঁর অপরাধের শাস্তি পেয়েছেন; এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে বিচার বিভাগ এবং পুলিশের প্রতি আস্থা নষ্ট হতে বাধ্য। দেখতে হবে যে এই ঘটনাটি যোগীর ‘আইনশৃঙ্খলা’ মডেলে ভাসমান ভোটারের বিশ্বাস ভেঙে দেয় কিনা।

প্রশ্ন হলো, যোগী আদিত্যনাথ কীভাবে পরবর্তী নরেন্দ্র মোদি হবেন? যেখানে যোগী বারবার ‘আইনশৃঙ্খলা’কে তাঁর সরকারের শক্তিশালী বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন, সেখানে আতিক হত্যাকাণ্ড মধ্যপন্থি ভোটারদের কাছে এ ধরনের দাবির অসারতা প্রমাণ করতে পারে। অন্তত তাদের কাছে এই হত্যাকাণ্ড ন্যায়বিচারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার উপলক্ষ। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর মনে রাখা ভালো– কট্টর হিন্দুত্ববাদের কৌশল দেশের সব জায়গায় সমানভাবে কাজ করবে না এবং সব ভোটার তাঁকে ‘সন্দেহহীন’ সমর্থন দেবে না।

ভারতের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মধ্য-উদারপন্থি, যাদের বুলডোজারের প্রতি আগ্রহ নেই এবং দূরবর্তী রাজ্যে এনকাউন্টারে হত্যা মেনে নিতে পারে না। যোগী আদিত্যনাথের লৌহমানব হওয়ার প্রবণতা তারা মেনে নিতে পারে না। তিনি যদি নরেন্দ্র মোদির উত্তরসূরি হতে চান, তাঁকে নিজের ভাবমূর্তি পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে হবে। নরেন্দ্র মোদির মতো তাঁকেও একজন রাষ্ট্রনায়ক এবং জাতীয় নেতার ভাবমূর্তি তৈরির প্রয়াস চালাতে হবে। আতিক হত্যার বিষয়ে একটি ন্যায্য ব্যাখ্যা এবং এর বিচারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে যদি তিনি তা শুরু করেন, সেটি তাঁর জন্য ভালো হবে।

অমিতাভ তিওয়ারি: ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক; দ্য কুয়িন্ট থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.