বেশি দামে ডলার বিক্রি: শাস্তির মুখে ১০ ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান

0
194
ডলার

ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে আমদানিকারকের কাছে ডলার বিক্রি করায় বেসরকারি খাতের ১০ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে এসব ব্যাংকের ট্রেজারি-প্রধানকে জরিমানা করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বেশি দামে ডলার বিক্রির জন্য এসব ব্যাংকের ট্রেজারি-প্রধান দায় এড়াতে পারেন না বলে ব্যাংকগুলোর কাছে গত সোমবার পাঠানো চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ট্রেজারি বিভাগ ব্যাংকের টাকা ও ডলারের চাহিদা-জোগানের বিষয়টি নিশ্চিত করে থাকে। কোনো কোনো ব্যাংকে ট্রেজারি বিভাগের প্রধান পদে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাও রয়েছেন।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই ১০ ব্যাংক হলো মার্কেন্টাইল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংক। শাস্তির আওতায় আসা ব্যাংকের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।

একই অভিযোগে গত বছরের আগস্টে একসঙ্গে দেশি-বিদেশি ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি-প্রধানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

এ নিয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে নিজ নিজ ব্যাংকের দ্বিপক্ষীয় বিষয়। এমন চিঠি নিয়মিত আসে। তাই এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’

চিঠি পেয়েছে, এমন একাধিক ব্যাংকের এমডিও এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাঁরা জানান, এ নিয়ে কথা বলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনানুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। গণমাধ্যমে কোনো মন্তব্য করলে আরও খড়্গ আসতে পারে বলে জানানো হয়েছে।

খাদ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় উল্লেখ করে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক শীর্ষস্থানীয় একটি গ্রুপ সরকারের উচ্চপর্যায়ে নথিপত্র জমা দেয়, এরপরই এ ব্যবস্থা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘বাজারই ডলারের দাম ঠিক করবে, এটাই নিয়ম। এত দিন ডলার বিক্রি করে দাম ধরে রাখার চেষ্টা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সেই পরিস্থিতিও নেই। এখন যেভাবে ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। এভাবে ডলারের দাম ধরে রাখা সম্ভব নয়। বেশি দামে কিনে ব্যাংকগুলো কম দামে ডলার বিক্রি করবে, এটা আশা করা ঠিক হবে না। বাজারব্যবস্থা কীভাবে শক্তিশালী ও কার্যকর করা যায়, সেদিকেই নজর দেওয়া উচিত। এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় আনা কমিয়ে দিতে পারে। আর প্রবাসী আয় হুন্ডিতে চলে গেলে তা ব্যাংকে ফেরানো কঠিন হবে। এতে বাড়বে অর্থ পাচারও।’

কেন এ ব্যবস্থা

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে গত বছরের শেষ প্রান্তিক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ডলারের দাম নির্ধারণ করছে। পণ্য বা সেবার রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রের ডলারের নতুন দাম ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। অন্যদিকে আমদানিকারকদের কাছে এখন ১১০ টাকায় ডলার বিক্রি করছে ব্যাংকগুলো।

তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু ব্যাংক প্রতি ডলারে ১১৪-১১৫ টাকা দাম নিচ্ছে। কারণ, প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। না হলে ঋণপত্র খুলতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না ব্যাংকগুলো।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, খাদ্যপণ্যের দাম কেন বাড়ছে, এর ব্যাখ্যা দিয়ে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক একটি শীর্ষস্থানীয় গ্রুপ সম্প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ে তাদের আমদানি ব্যয় উল্লেখ করে একগুচ্ছ নথিপত্র জমা দেয়। পরে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক দল অভিযুক্ত ব্যাংকগুলোর শাখা ও প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করে। এতে ঘোষণার চেয়ে ডলারের দাম বেশি নেওয়ার বিষয়ে তথ্যপ্রমাণও মেলে। এরপরই ৩ সেপ্টেম্বর চিঠি দিয়ে ব্যাংকগুলোর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

চিঠি পাওয়া বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিন ডলারের দাম কত হবে, তা ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে ১০ হাজারের বেশি ডলারের ক্ষেত্রে দাম তাৎক্ষণিকভাবে নির্ধারিত হয়, এটাও ঘোষণায় বলা হয়। বাস্তব পরিস্থিতি না বুঝে এরপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আমদানির জন্য বেশি দামে ডলার কিনে দায় মেটানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। ব্যাংক বেশি দামে ডলার কিনে কম দামে বিক্রি করতে পারে না। কারণ, ব্যাংক কোনো দাতব্য সংস্থা নয়।

চিঠিতে যা বলা হয়েছে

ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হওয়ায় কেন ট্রেজারি-প্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে সোমবার ১০ ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘করপোরেট গ্রাহকের কাছে নির্ধারিত দরের চেয়ে উচ্চ হারে বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রয় প্রসঙ্গে’।

এমডিদের উদ্দেশে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘গত ৩ সেপ্টেম্বর পাঠানো চিঠিতে আমদানি বিল পরিশোধের জন্য করপোরেট ডিলের নামে গ্রাহকের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্টকৃত ও ব্যাংকের ঘোষিত দরের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণের অভিযোগের বিপরীতে আপনাদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হয়নি। বেশি দামে ডলার লেনদেনে আপনাদের ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান তাঁর দায় এড়াতে পারেন না।’ ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১০৯ (৭) ধারা অনুযায়ী কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, চিঠি পাওয়ার ৫ কর্মদিবসের মধ্যে সে বিষয়ে জবাব দিতে বলা হয়।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১০৯ (৭) ধারা অনুযায়ী, এই অপরাধে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করা যেতে পারে। যদি আইনের একই ধারার লঙ্ঘন অব্যাহত থাকে, তাহলে প্রথম দিনের পর প্রতিদিনের জন্য অতিরিক্ত এক হাজার টাকা জরিমানা আরোপ করা যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, জবাব পাওয়ার পর আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ডলারের দাম ঘোষণা দিয়েছে এক, করপোরেট গ্রাহকের কাছে নিয়েছে আরেক দাম। এ জন্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে না কেন, তা জানতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর আগে একই ধরনের অপরাধে কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারি-প্রধানকে বদলি করা হয়েছিল। বদলির থেকে জরিমানা অনেক কঠোর শাস্তি। এটা একজন কর্মকর্তার ক্যারিয়ারের সঙ্গে সম্পর্কিত।

বছর দেড়েক ধরে চলা ডলার-সংকট এখনো কাটেনি। এই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। আমদানিকারকেরা বলছেন, তাঁরা চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। খোলাবাজারেও নগদ ডলারের সংকট চলছে। সেখানে প্রতি ডলারের দাম উঠেছে ১১৮ টাকা।

সানাউল্লাহ সাকিব

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.