বিয়ে নিয়ে আইনি জটিলতা এড়াতে যা জানতে হবে

0
123
বিয়ের মুহুর্তগুলোতে থাকে আন্তরিকতা আর ভালোবাসা

বিয়ের বয়স কত?

বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ের বয়স হতে হবে ন্যূনতম ১৮ বছর এবং ছেলের বয়স হতে হবে ন্যূনতম ২১ বছর। যদি ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়েকে কিংবা ২১ বছরের নিচে কোনো ছেলেকে বিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ছেলে ও মেয়ের উভয়ের অভিভাবক এবং বিয়ে পরিচালনার কাজে যাঁরা জড়িত ছিলেন, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী তাঁরা দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। যদি দেখা যায় ছেলের বয়স ২১ বছর হয়েছে, কিন্তু মেয়ের বয়স ১৮ বছর হয়নি, তাহলে ছেলের অভিভাবকেরা নয়, বরং ছেলে নিজে এবং অন্য ব্যক্তিরা যাঁরা বিয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরা দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন। সে ক্ষেত্রেও দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

বিয়ের ক্ষেত্রে অযোগ্যতা কী?

‘প্রহেবিটেড’ অর্থাৎ ‘নিষিদ্ধ ব্যক্তি’কে বিয়ে করা যাবে না। প্রতিটি ধর্মেই বিয়ের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ব্যক্তি আছে। বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা-চাচি, খালা-খালু, দাদা-দাদি অথবা সৎভাই-বোন, সৎমা-বাবা, নাতি-নাতনি—এ রকম যাঁরা বিয়ের জন্য নিষিদ্ধ ব্যক্তি আছেন, তাঁদের কোনোভাবেই বিয়ে করা যাবে না। কোনো ব্যক্তি যদি গুরুতর মানসিক সমস্যায় থাকে অথবা পুরোপুরি পাগল হয়ে যান তাঁকেও বিয়ে করা যাবে না। এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন, বিয়ে–পরবর্তী সময়ে যাঁকে বিয়ে করবেন, তাঁরও সেই আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে তা আইনত বিয়ের ক্ষেত্রে অযোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে ।

অভিভাবক ছাড়া বিয়ে করলে কী হবে?

যদি কোনো পক্ষের অভিভাবক বা উভয় পক্ষের অভিভাবক বিয়েতে অসম্মতি জানান কিন্তু ছেলে ও মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক এবং অন্যান্য আইনগত যেসব যোগ্যতা আছে, তাঁরা সেগুলো পূরণ করে থাকেন, তবে সে বিয়েতে কোনো বাধা নেই। তবে অভিভাবক ছাড়া বিয়ে করলে, পরবর্তী বিভিন্ন ধরনের আইনি জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অভিভাবক ছাড়া বিয়ের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের বাস্তবতায় অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদি মামলা হওয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে।

বিয়ের রেজিস্ট্রেশন কি বাধ্যতামূলক?

বিয়ের রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক এবং এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিয়ের প্রমাণও বটে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি থানায় যে নিকাহ রেজিস্ট্রার আছে অথবা হিন্দুদের ক্ষেত্রে পুরোহিত এবং খ্রিষ্টানদের ক্ষেত্রে যে খ্রিষ্টান ম্যারেজ আইন অনুযায়ী যে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁর কাছে রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামূলক। কেননা বিয়ে–পরবর্তী যেকোনো জটিলতায় অথবা সাকসেশন–পরবর্তী যেকোনো জটিলতায় অবশ্যই বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের নথিপত্র দেখাতে হবে।

দেনমোহর কখন দিতে হয়?

মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর অত্যাবশ্যক একটি বিষয় এবং অবশ্যই পরিশোধ তা করতে হবে। অনেকেই মনে করেন, দেনমোহর শুধু তালাকের সময় পরিশোধ করতে হয়। আবার কেউ কেউ ভাবেন, এটা পরিশোধ করতেই হয় না, এমনিতেই টাকার অঙ্কের কথা উল্লেখ করা থাকে। প্রকৃতপক্ষে, স্ত্রী যখনই চাইবেন, তখনই দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে স্বামী বাধ্য থাকবেন। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী চাইলে পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারেন। তালাক হোক বা না হোক, দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে স্বামী বাধ্য থাকবেন।

দেনমোহরের টাকা পরিশোধ না করে যদি স্বামী মারা যান, তবে তাঁর সম্পত্তি থেকে প্রথম দেনমোহরের টাকা আদায় করার অধিকার স্ত্রীর থাকবে। এ জন্যই দেনমোহরের টাকা ততটুকুই লিখতে হবে, যতটুকু একজন স্বামী পরিশোধ করতে পারবেন।

ভরণপোষণ কে দেবে?

প্রতিটি পারিবারিক আইনে স্বামীর ওপর ভরণপোষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ একজন পুরুষ তাঁর স্ত্রী এবং তাঁর সন্তানদের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। ভরণপোষণ বলতে মূলত খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি বোঝায়। কোনো ধরনের বিলাসী পণ্য দিতে স্বামী বাধ্য নন। ভরণপোষণের টাকা কতটুকু হবে, তা নির্ভর করবে স্বামীর উপার্জনের ওপর।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

উপহার নাকি যৌতুক?

অনেক সময় উপহারের নামে যৌতুক চাওয়া হয়। অনেক সময় বলা হয়, আত্মীয়স্বজন দেখবে মেয়ের বাসা থেকে কী কী দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উপহারের নামে যৌতুক চাওয়াটা অপরাধ। ছেলে বা মেয়ে যে পক্ষই যৌতুক চাইবে, তারা যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। এ ছাড়া যৌতুকের জন্য পরে যদি কোনো নির্যাতন চালানো হয়, তবে স্ত্রী চাইলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করতে পারেন। অন্যদিকে স্বামী নির্যাতনের শিকার হলে দণ্ডবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ পারেন। মনে রাখতে হবে, বিয়ে–পরবর্তী সময়ে ঈদ বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন জিনিসপত্র দেওয়ার জন্য যে চাপ দেওয়া হয়, এগুলোও কিন্তু যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত।

একাধিক বিয়ে করলে কী হবে?

স্বামী বা স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় আরেকটি বিয়ে করা যাবে না। করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে ছেলেদের ক্ষেত্রে এখানে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। যদি কোনো মুসলিম পুরুষ মুসলিম স্ত্রীর অনুমতি পান এবং সে অনুমতি সাপেক্ষে কেন তিনি বিয়ে করতে চান, তার কারণগুলো উল্লেখ করে ইউনিয়ন পরিষদ বা সিটি করপোরেশনে চেয়ারম্যান বা মেয়র বরাবর আবেদন করতে পারেন। তিনি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে তাঁর বিয়ে করার বিশেষ কোনো কারণ আছে, যেমন তাঁর স্ত্রী মানসিক ভারসাম্যহীন অথবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, তবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা সিটি করপোরেশনের মেয়র বিষয়টি বিবেচনা করে অনুমতি দিতে পারেন। তবে এ ধরনের অনুমতির বিরুদ্ধে চাইলে সহকারী জজ আদালতে মামলা করা যায়।

ভিন্নধর্মাবলম্বী হলে কীভাবে বিয়ে করবেন?

যদি ছেলে বা মেয়ে দুটি ভিন্ন ধর্মের অনুসারী হন এবং তাঁদের যদি একে অন্যের ধর্মে পরিবর্তিত হতে না পারেন বা না চান, তাহলে ১৮৭২ সালের স্পেশাল ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট অর্থাৎ বিশেষ বিবাহ নিবন্ধন আইন অনুযায়ী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবেন।

বিয়েসংক্রান্ত প্রতারণা হলে কী করবেন?

বিয়ের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে অনেক সময়ই বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা হয়ে থাকে। যেমন শুধু স্ট্যাম্পে লিখে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু রেজিস্ট্রারের কাছে যতক্ষণ পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন না হচ্ছে, সে বিয়েটি আদৌ রেজিস্ট্রার্ড কোনো বিয়ে না। কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে যা বলা হয়, সেটা হচ্ছে একটা অ্যাডিশনাল ডকুমেন্টমাত্র। অর্থাৎ সেটি শুধু প্রমাণ করে যে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে হয়েছে। কিন্তু সেটি আদৌ বিয়ের রেজিস্ট্রেশন নয়। তাই এ ধরনের প্রতারণা থেকে বাঁচতে অবশ্যই রেজিস্ট্রারের কাছে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এ ছাড়া যদি কোনো ব্যক্তি আগের বিয়ে গোপন করে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তবে সেটা জানার সঙ্গে সঙ্গেই মামলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে বিয়েসংক্রান্ত প্রতারণার মামলা করা যাবে।

ইশরাত হাসান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.