বিদেশে যাবে আম, ৯৩০ বাগানে বিশেষ ব্যবস্থা

0
194
নিরাপদ উৎপাদনের জন্য আম মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। ১৫ মে নওগাঁর সাপাহার উপজেলার গোডাউন পাড়া এলাকার একটি বাগানে

বাংলাদেশে বছরে ১২ লাখ টনের বেশি আম উৎপাদিত হয়। তবে রপ্তানি কম।

নওগাঁর সাপাহারের কৃষি উদ্যোক্তা মো. সোহেল রানার ১৫০ বিঘার আমবাগান রয়েছে। এর মধ্যে দেড় বিঘা জমির বাগানে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আম উৎপাদন করছেন তিনি। কারণ, এসব আম বিদেশে যাবে।

দেড় বিঘার বাগানটি গৌড়মতি (বারি-১২) জাতের আমগাছের। এই বাগানে রপ্তানির জন্য আম উৎপাদন করতে সরকারের পক্ষ থেকে সোহেল রানা সার, বালাইনাশক, ফলের ব্যাগসহ (ফ্রুটব্যাগ) নানা কৃষি উপকরণ পেয়েছেন। সঙ্গে পেয়েছেন বিশেষ প্রশিক্ষণ।

সোহেল রানা বলছিলেন, রপ্তানির আমের জন্য বিশেষ যত্ন দরকার হয়। আমের শত্রু মাছি ও পোকা। এই পোকা ঠেকাতে আমের বয়স ৪৫ থেকে ৫০ দিন হলেই ফ্রুটব্যাগ পরাতে হয়। কীটনাশক ব্যবহারের একটি নির্দিষ্ট সময় পর আম পাড়তে হয়।

‘বিদেশে আমাদের আমের বিরাট বাজার রয়েছে। এবার আমরা গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি অর্থাৎ চার হাজার মেট্রিক টন আম রপ্তানি করতে চাই। তার জন্যই খামারিদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
মোহাম্মদ আরিফুর রহমান, রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক

শুধু নওগাঁর সোহেল নন। দেশের ৯৩০ জন কৃষি উদ্যোক্তা এ মৌসুমে বিদেশে রপ্তানির জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আম উৎপাদন করছেন। কাজটি হচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) ‘রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের’ আওতায়। দেশে এই প্রথম রপ্তানিবাজার লক্ষ রেখে আম উৎপাদনের জন্য উদ্যোক্তাদের সরকারিভাবে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রকল্পের লক্ষ্য, প্রাথমিকভাবে ৯৩০ উদ্যোক্তাকে বেছে নেওয়া হলেও আগামী চার বছরের মধ্যে সংখ্যাটি ৮ হাজার ৪০০ জনে উন্নীত করা হবে।

উল্লেখ্য, শুধু ৯৩০ বাগানের আম রপ্তানি হবে, বিষয়টি তেমন নয়। এর বাইরে নানা উদ্যোগে মান অনুসরণ করে আম রপ্তানি হয়ে থাকে।

স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের আমের মান ভালো বলে মনে করেন কৃষিবিদেরা। তাঁরা বলছেন, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের আমের চাহিদাও রয়েছে। বিশেষ করে বিদেশে থাকা এক কোটি বাংলাদেশির একটা বড় বাজার হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আম রপ্তানির পরিমাণ খুব কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, ইতালি, কাতার ও কুয়েতে।

কৃষি অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৭৫৭ মেট্রিক টন আম রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ৭৯১ টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ১২ লাখ টনের কিছু বেশি আম উৎপাদিত হয়।

‘ফাইটো স্যানিটারি সার্টিফিকেট পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। আবার রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশ ভারত, পাকিস্তান বা থাইল্যান্ডের উড়োজাহাজ ভাড়ার চেয়ে আমাদের দেশ থেকে ভাড়া অনেক বেশি।
মনজুরুল ইসলাম, রপ্তানিকারকদের সংগঠনের উপদেষ্টা

বাংলাদেশ আম রপ্তানিকারক দেশের শীর্ষ তালিকায় নেই। ফলবাজার নিয়ে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক পর্যালোচনা প্রতিবেদন বলছে, সবচেয়ে বেশি আম রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান রয়েছে। ২০২২ সালে ভারত ১ লাখ ৭৩ হাজার টনের মতো আম রপ্তানি করেছে। পাকিস্তানের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৪১ হাজার টন। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করেছে মেক্সিকো—৪ লাখ ৬৮ হাজার টন। থাইল্যান্ড রপ্তানি করেছে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার টন আম।

রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান বলেন, ‘বিদেশে আমাদের আমের বিরাট বাজার রয়েছে। এবার আমরা গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি অর্থাৎ চার হাজার মেট্রিক টন আম রপ্তানি করতে চাই। তার জন্যই খামারিদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে।’

রপ্তানিতে যত বাধা

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশের আম রপ্তানির কিছু বাধা চিহ্নিত করেছে। যার মধ্যে রয়েছে দেশে পরিকল্পিতভাবে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে মানসম্মত নিরাপদ আম উৎপাদন করা হয় না। আম সংগ্রহের পর ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আমদানিকারকদের দেওয়া শর্ত পূরণ হয় না।

আম উৎপাদন ও বিপণনব্যবস্থায় (ভ্যালুচেইন) আম উৎপাদনকারী, সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, গবেষক এবং রপ্তানিকারকদের সমন্বয়ের অভাব। আম সংগ্রহের পর আমের গুণগত মান বজায় রেখে যথাযথভাবে বাছাই (গ্রেডিং) ও মোড়কজাত করে শীতলীকরণ ব্যবস্থাসংবলিত বাহনের (কুলিং ভ্যান) মাধ্যমে পরিবহন করা হয় না।

রপ্তানির জন্য আম উৎপাদনে যুক্ত উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণে এসব সমস্যার বিষয় উঠে এসেছে বলে জানান চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের কৃষি উদ্যোক্তা ইসমাইল হোসেন খান। তিনি বিদেশে পাঠানোর জন্য ল্যাংড়া ও বারোমাসি জাতের আমবাগান করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা দাবি ছিল, রপ্তানির জন্য বিশেষ সহযোগিতা চাই। এবার সেটা পাওয়া গেছে। রপ্তানিকারকদের সঙ্গে আরও নিবিড় যোগাযোগের ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে।’

উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকেরা যা বলেন

দেশের যেসব অঞ্চলে বেশি আম উৎপাদিত হয়, এর মধ্যে আছে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর এবং তিন পার্বত্য জেলা। এসব জেলার সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব অনেক। তাই পরিচর্যা করে আম উৎপাদন করেও রপ্তানির জন্য মোড়কজাত করতে ঢাকার শ্যামপুরের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। সেখানে ডিএইর অধীনে রপ্তানির জন্য মোড়কজাতের ব্যবস্থা রয়েছে, যার নাম সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউস।

দূর থেকে আম এনে মান ধরে রাখা সম্ভব হয় না বলে মনে করেন রাজশাহীর বাঘার আম উৎপাদনকারী মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি মনে করেন, বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে একটি মোড়কজাতকরণ কারখানা থাকা দরকার।

দেশের আম বিদেশে রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির উপদেষ্টা মো. মনজুরুল ইসলাম রপ্তানির ক্ষেত্রে দুটি বড় সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। আম বিদেশে পাঠানোর জন্য দরকারি উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ বা ‘ফাইটো স্যানিটারি’ সনদ পেতে দীর্ঘসূত্রতা। আর উড়োজাহাজের উচ্চ হারে ভাড়া।

সঙ্গনিরোধ সনদ দেয় কৃষি অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ শাখা। আম বা এ ধরনের পণ্যের মান পরীক্ষা করে তা সঠিক বলে বিবেচিত হলেই এ সনদ পাওয়া যায়। রপ্তানিকারকদের সংগঠনের উপদেষ্টা মনজুরুল ইসলাম গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘ফাইটো স্যানিটারি সার্টিফিকেট পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। আবার রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশ ভারত, পাকিস্তান বা থাইল্যান্ডের উড়োজাহাজ ভাড়ার চেয়ে আমাদের দেশ থেকে ভাড়া অনেক বেশি।’

উড়োজাহাজের বেশি ভাড়া আম রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি সমস্যা বলে মনে করেন ‘রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের’ পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান। তবে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ সনদ পেতে দেরি হওয়ার বিষয়টি নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যা ভিন্ন। তাঁর ভাষ্য, এই সনদের বলেই বিদেশে পণ্য যায়। তাই এখানে কড়াকড়ি থাকে। না থাকলে যে সমস্যা হয়, সে প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ তুলে ধরেন তিনি। যেমন বাংলাদেশ থেকে করলা রপ্তানি বন্ধ। কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের করলার ব্যাপক চাহিদা আছে। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটতে পারে যে প্রচলিত পণ্যের সঙ্গে কেউ কেউ করলা তুলে দিয়েছেন।

আরিফুর রহমান বলেন, ‘মান নিয়ন্ত্রণে যৌক্তিকভাবে কড়াকড়ি করা হয়। কারণ, এতে দেশের স্বার্থ জড়িত। কোনো কারণে পণ্যের মান খারাপ হলে আখেরে আমাদের ক্ষতি হয়।’

দেশেও ‘চাই নিরাপদ’ আম

দেশে আমের মৌসুম শুরু হয়েছে। বাজারে দোকানে দোকানে আম বিক্রি হচ্ছে। আগামী আগস্ট পর্যন্ত ফলবাজারে ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি থাকবে আম নিয়ে। দেশের মানুষও নিরাপদ আম পেতে চায়।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ইকবাল রউফ মামুন বলেন, রপ্তানির জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আম উৎপাদন ভালো উদ্যোগ। তবে দেশের বাজারে যে আম আসছে, তাতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ (রেসিডিউ) গ্রহণযোগ্য মাত্রার বেশি থাকছে কি না, পাকানোর ব্যবহার করা উপাদানগুলোর সহনীয় মাত্রায় প্রয়োগ করা হচ্ছে কি না, তা দেখা দরকার।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.