ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের দায়ের করা দুই মামলায় বিচার শুরুর আগেই এক বছর ধরে কারাগারে বন্দি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা। অথচ যে আইনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সেই আইনটিই বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিচার শেষ হওয়ার আগে খাদিজার এক বছরের কারাবাস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
২০২০ সালে খাদিজার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। দুই বছর পর গত বছরের ২৭ আগস্ট পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিন থেকে সাত বছরের সাজা হতে পারে। বিশিষ্টজন বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুর্বলতা এটিই। বিচার শেষ হওয়ার আগে চাইলেই অজামিনযোগ্য ধারায় যে কাউকে দীর্ঘদিন কারাগারে রাখা যায়। এটি আইনের শাসনের পরিপন্থি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু একই অপরাধের জন্য নতুন আইন করা হচ্ছে, যেটি সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে পরিচিত হবে। এ ক্ষেত্রে খাদিজাসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় যারা কারাগারে আছেন, তাদের ব্যাপারে আদালতের মাধ্যমে কী করা যায়, তা নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। আমরা এটি করব। নতুন আইনের মাধ্যমেও এটি হতে পারে।’
গত জুলাইয়ে আপিল বিভাগের এক আদেশে আগামী ১০ নভেম্বর পর্যন্ত (৪ মাস) তাঁর জামিনসংক্রান্ত আবেদনের শুনানি স্ট্যান্ডওভার (মুলতবি) রাখা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৪ বিচারপতির বেঞ্চ এ আদেশ দেন। ফলে খাদিজার আইনজীবীদের নতুন কোনো আইনি তৎপরতা ছাড়া এর আগে তাঁর জামিনসংক্রান্ত আবেদন শুনানির সুযোগ নেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিচার শুরু হওয়ার আগেই খাদিজার এক বছরের কারাবাস তাঁর মৌলিক অধিকার খর্ব করেছে। প্রশ্নবিদ্ধ করছে বিচারিক প্রক্রিয়াকেও। এই আইনের আওতায় এর আগেও দেশের অনেক মানুষ গ্রেপ্তার, কারারুদ্ধ ও নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এমনকি কারও কারও মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। এটি মানুষের বাকস্বাধীনতা, নাগরিক অধিকারসহ মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
খাদিজা জবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। অনলাইনে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচারসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে ২০২০ সালের অক্টোবরে খাদিজা ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাজধানীর কলাবাগান ও নিউমার্কেট থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ। দুটি মামলার এজাহারও প্রায় একই।
এজাহারে বলা হয়েছে, বাদী ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর মেজর দেলোয়ার হোসেনের ইউটিউব চ্যানেলে ‘হিউম্যানিটি ফর বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক ভিডিও দেখতে পান। সেখানে সঞ্চালক খাদিজাতুল কুবরার উপস্থাপনায় অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার হোসেন তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশ বৈধ গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করেন।
এতে আরও দেখা যায়, সঞ্চালক খাদিজাতুল কুবরা ও মেজর দেলোয়ার তাদের ইউটিউব চ্যানেল এবং ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজগুলোতে উল্লিখিত ভিডিওগুলো আপলোড করে বাংলাদেশে চলমান স্থিতিশীল পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা তাদের মিথ্যা তথ্যপূর্ণ আলোচনা ইউটিউব, ফেসবুকে প্রচার করে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়ে তাদের সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া তারা উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচারের মাধ্যমে সরকারবিরোধী মনোভাব তৈরি করে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করছে। এটা ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৯, ৩১ ও ৩৫ ধারার অপরাধ বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
২০২২ সালে এই দুই মামলায় আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করে পুলিশ। পরে অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল খাদিজা ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এর পর গত বছরের ২৭ আগস্ট মিরপুরের বাসা থেকে খাদিজাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সঞ্চালক খাদিজা গ্রেপ্তার হলেও মেজর দেলোয়ার এখনও বিদেশে অবস্থান করছেন। বিচারিক আদালতে একাধিকবার খাদিজার জামিন আবেদন নাকচ হয়। পরে তিনি হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে জামিন দেন হাইকোর্ট। পরে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে গত ১০ জুলাই আপিল বিভাগ ওই আদেশ চার মাসের জন্য মুলতবি রাখেন। খাদিজা বর্তমানে কাশিমপুর মহিলা কারাগারে বন্দি।
আমলে নেওয়া হয়নি বয়স
২০২০ সালে খাদিজার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সময় খাদিজার বয়স ছিল ১৭ বছর। তাঁর বোন সিরাজুম মুনিরা বলেন, বিচারের সময় তার বয়সকে আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এটি যদি আমলে নেওয়া হয়, তাহলে তার বিচার হবে শিশু আদালতে। উচ্চ আদালতের কাছে খাদিজার মুক্তি দাবি করে তিনি আরও বলেন, খাদিজা মেধাবী শিক্ষার্থী। তার জীবন কারাগারে শেষ হতে পারে না। উচ্চ আদালত খাদিজার বয়স এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের সিদ্ধান্তের বিষয়টি বিবেচনা করে তাকে মুক্তি দেবেন– এটাই প্রত্যাশা তাঁর।
আইনি উপায়
খাদিজার জামিনের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ প্রসঙ্গে তাঁর আইনজীবী বিএম ইলিয়াস কচি বলেন, আপিল বিভাগ খাদিজার জামিন আবেদনের শুনানি মুলতবি রাখায় জামিন স্থগিত থাকছে। তবে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিলের সিদ্ধান্ত কার্যকর করলে নতুন প্রেক্ষাপটে খাদিজার জামিনের বিষয়ে উচ্চ আদালতে ফের আবেদন করা যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নিঃশর্ত মুক্তির আবেদন অ্যামনেস্টির
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল খাদিজার মুক্তির দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লিখেছে। শুক্রবার লেখা চিঠিতে সংস্থাটি বলেছে, তাঁর এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া উচিত। তাঁর ডিগ্রির জন্য অধ্যয়ন করা উচিত। একটি কঠোর আইনে তাঁর জেলে থাকার কথা নয়। চিঠিতে বলা হয়, খাদিজার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করুন এবং অবিলম্বে তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিন। শুধু মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগ করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে অভিযুক্ত এবং আটক সবাইকে মুক্তি দিন। খাদিজাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
আবু সালেহ রনি