২০১৮–তে জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতিকে হটিয়ে নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল দখলে নিয়েছিলেন সাদিকপন্থীরা।
বরিশাল সিটি নির্বাচনে খায়ের আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই দলটির সাদিকপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতারা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। ক্ষমতার পালাবদলে এখন নগরের পরিবহন খাতে সাদিক আবদুল্লাহর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ তাঁর সমর্থক নেতারা নগরের দুটি বাস টার্মিনালকেন্দ্রিক বাস মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন ‘স্বেচ্ছায়’ ছেড়ে দিয়েছেন।
আগের মেয়াদে বরিশালের মেয়র হিসেবে সাদিক আবদুল্লাহ দায়িত্ব নেওয়ার পর তৎকালীন নেতাদের হটিয়ে বাস মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন দখলে নিয়েছিলেন তাঁর সমর্থক নেতারা। সেগুলো এখন আবার পুরোনোদেরই দখলে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলেরই এক পক্ষ থেকে আরেক পক্ষের কাছে বরিশালের পরিবহন খাতের ক্ষমতার হাতবদল হচ্ছে।
খায়ের আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ নেতারা বলছেন, পালাবদলের আগে যাঁদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছিল, তাঁরা স্বাভাবিকভাবে কিছুটা আশাবাদী হচ্ছেন। আর যাঁরা অন্যায় করেছিলেন, তাঁরা নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন। তাঁরা নিজেরাই পথ দেখছেন।
২০১৮ সালের শেষে জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি ও মহানগর শ্রমিক লীগের সভাপতি আফতাব হোসেনকে হটিয়ে নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল দখলে নিয়েছিলেন সাদিক আবদুল্লাহর সমর্থক নেতারা। এবার সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় দৃশ্যপট বদলে যায়। তাঁর সমর্থক হিসেবে পরিচিত জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মাসরেক ১৮ মে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। তবে সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে পদত্যাগ করেননি। আফতাবকে পুনরায় সভাপতি পদ নেওয়ার প্রস্তাব দেন সমিতির সদস্যরা। পরে তিনি সভাপতির দায়িত্ব নেন।
সমিতি সূত্র জানায়, আফতাবকে হটিয়ে গোলাম মাসরেককে সভাপতি করা হলেও মূলত সমিতির নিয়ন্ত্রক ছিলেন সাদিকের সমর্থক মহানগর ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়ক রইজ আহমেদ ওরফে মান্না। সিটি নির্বাচনের সময় দলীয় প্রার্থীর সমর্থকদের মারধরের ঘটনায় তিনি গ্রেপ্তার হন। পরে মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্র। এর পর থেকেই নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে মালিক সমিতির সাদিক পক্ষের নেতাদের আধিপত্য খর্ব হয়।
নতুন সভাপতির দায়িত্ব নেওয়া আফতাব হোসেন বলেন, ‘আমাকে অন্যায়ভাবে সমিতির সভাপতির পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এখন তাঁরাই আবার দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করেন। আমি জোর করিনি, সভাপতি মাসরেক স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার পর সমিতি থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। তাই নিয়েছি।’
সাদিক পক্ষের নেতা হিসেবে পরিচিত সমিতির সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে বলেন, ‘সভাপতি পদত্যাগ করার পর আমরা আফতাব হোসেনকে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেছি। তিনি নিয়েছেন। এখানে কোনো চাপ প্রয়োগ বা বিশৃঙ্খলা হয়নি।’ আগে আফতাবকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া বৈধ ছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব দেননি।
শুধু নথুল্লাবাদ নয়, জেলা বাস, মিনিবাস, কোচ ও মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়ন দখলে নিয়েছেন পুরোনোরা। ইউনিয়নটি রূপাতলী বাস টার্মিনালকেন্দ্রিক শ্রমিকেরা নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরা জানান, ১৬ মে সকালে রূপাতলী বাস টার্মিনাল দখলে নেন বঞ্চিত জেলা বাস, মিনিবাস, কোচ ও মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের (একাংশ) সম্পাদক আরিফুর রহমান মোল্লা ওরফে সুমন। আগে টার্মিনালটি সাদিকপন্থীদের দখলে ছিল। আরিফুর রহমান ১৬ মে সকালে অনুসারীদের নিয়ে কার্যালয়ের তালা খুলে ইউনিয়নের কার্যক্রম শুরু করেন। এ সময় সাধারণ শ্রমিকেরাও তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা জানান।
মহানগর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক পরিমল চন্দ্র দাসকে সভাপতি এবং থ্রি–হুইলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি শাহরিয়ার আহম্মদ ওরফে বাবুকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০২১ সালের ২৭ এপ্রিল বরিশাল জেলা মিনিবাস, কোচ ও মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিই এত দিন রূপাতলী বাস টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণ করছিল। সেখানকার একাধিক শ্রমিক অভিযোগ করেন, পরিমল-শাহরিয়ার শ্রমিক ইউনিয়নের দায়িত্ব নেওয়ার পর পুরোনো অনেক শ্রমিককে বেকার রাখা হয়েছিল। অর্ধশত শ্রমিককে কোনো কাজ দেওয়া হতো না। এ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল।
সিটি নির্বাচনে এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি বিদায়ী মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ। পেয়েছেন তাঁর চাচা খায়ের আবদুল্লাহ। ১২ জুন ভোটে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। নেতা-কর্মীরা বলছেন, খায়ের আবদুল্লাহ মনোনয়ন পাওয়ার পর সাদিকপন্থীরা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। নগরের বিভিন্ন খাতে সাদিক আবদুল্লাহর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হতে থাকে। খায়ের আবদুল্লাহকে ঘিরে বরিশাল আওয়ামী লীগে নতুন শক্তির উত্থান ঘটতে শুরু করে।
ক্ষমতার পালাবদলে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের যোগসূত্র আছে কি না, জানতে চাইলে খায়ের আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দীন বলেন, বিষয়টি এভাবে দেখা সমীচীন হবে না। কারণ, এত দিন নগরের সব বিষয়ই অনিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছিল; ‘জোর যার মুল্লুক তার’ ভিত্তিতে।
এখন পালাবদলের কারণে আগে যাঁদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছিল, তাঁরা স্বাভাবিকভাবে কিছুটা আশাবাদী হচ্ছেন। আর যাঁরা অন্যায় করেছিলেন, তাঁরা নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন। দখলদারেরা নিজেরাই পথ দেখছেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে জয়ের পর নগরে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আমরা কাউকে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সুযোগ দিইনি। আশা করি, ভবিষ্যতেও এমন অন্যায় সুযোগ কেউ পাবে না।’