বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে গ্রেফতার করা হয়েছিল

0
201
অলংকরণ– আরাফাত করিম

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন বন্দী করতে এল, তখন কী ভাবছিলেন শেখ মুজিব…

বন্দুক, কামান, ট্যাংকের গর্জন, গুলি-বোমার অস্তিত্ব চুরমার করা আওয়াজ, শ্রুতিকে বধির করা হুংকার, একটু আগে রাসেলকে ফিডারে দুধ খাওয়ানোর ফলে হাতে লেগে থাকা দুধের গন্ধ, সেই গন্ধের সঙ্গে মেশা বারুদের গন্ধ, পেট্রলের গন্ধ, ঘরপোড়া ছাইয়ের গন্ধ-এই সবকিছুর মধ্যে তিনি বসে আছেন মিলিটারি ট্রাকে, যাচ্ছেন অচেনা ব্যক্তিগত গন্তব্যে, আর বাংলার সুনিশ্চিত স্বাধীনতার অনিবার্য গন্তব্যের অনিশ্চিত পথরেখা ধরে। তাঁর মনের মধ্যে অকারণেই এই প্রশ্ন জাগে, নিজের কাছে তিনি কী! এর জবাবে একটুখানি হাসির প্রভা তাঁর উদ্বিগ্ন-ক্লান্ত মুখটাকে প্রসন্ন করে তোলে: ‘কিছুই তো করতে পারলাম না, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছিমাত্র।’ বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য, নীতি ও আদর্শের জন্য, তিনি একজন সামান্য ত্যাগ স্বীকারকারী মাত্র!

বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয়, যদি কেন, স্বাধীন তো হয়েই গেছে, তাঁর মুখের হাসি উজ্জ্বলতর হয়-লক্ষকোটি বছর ধরে গড়ে ওঠা হিমালয় থেকে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী, মধুমতী বয়ে পলি পড়ে পড়ে গড়ে উঠেছে যে বদ্বীপ, যে বদ্বীপের মানুষেরা চিরটাকাল কেবল শোষিত হয়েই এসেছে, অথচ একদিন যা ছিল সোনার বাংলা, মধুকর ডিঙা নিয়ে লখিন্দরেরা যে বাংলার নদী-সমুদ্র বেয়ে বাণিজ্যতরি নিয়ে ভাসানে যেত, মসলিনে, মসলায়, ধানে, শস্যে যে বাংলা ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী এলাকা, বিদেশি শোষণে-শাসনে যে সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণতপ্রায়, সেই বাংলার জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন হবে স্বাধীনতা। বাংলার মানুষ স্বাধীন হবে, বাংলার মানুষ মুক্তি পাবে-হয়তো তিনিই তখন থাকবেন না। তাঁকে যদি হত্যা করা হয়, তাঁকে যেন বাংলার মাটিতে অনন্ত শয্যায় শায়িত রাখা হয়। আমার এই মাটিতে জন্ম যেন এই মাটিতে মরি…

বিপরীত দিকে বেঞ্চিতে বসা একজন সৈনিক তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কোত্থেকে আসা একটা চকিত আলোর ঝলকানিতে তিনি দেখতে পান সৈনিকটির হেলমেট-ছায়াচ্ছন্ন মুখ। সম্ভবত মুজিবের মুখে হাসি দেখে সে বিস্মিত। একা একা হাসছে একটা লোক। তা-ও মিলিটারি ট্রাকে সশস্ত্র শত্রুসৈন্যদের মাঝখানে বসে থেকে, ব্যাপারটা কী! সৈন্যটি কি তাঁকে পাগল ঠাওরাচ্ছে!

তাঁর দুই পাশে খাকি পোশাক পরা অস্ত্রধারী সৈনিক। বিপরীত দিকেও বেঞ্চিতে সৈন্যরা বসা। এই ট্রাকের সামনের দিকে একটা ভারী অস্ত্র বসিয়ে সদা প্রস্তুত আরেকটা সৈনিক। ওই অস্ত্রটা কী? এলএমজি? রকেট লঞ্চার? শেখ মুজিব তা জানেন না। তাঁর ৫১ বছরের জীবনে কোনো দিন তিনি অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেননি। গোলাবারুদ, বন্দুক, কামান তাঁর অস্ত্র নয়। তাঁর অস্ত্র ন্যায্যতা। তাঁর অস্ত্র মানুষের ঐক্য। ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’

মাঝেমধ্যেই গোলাগুলির শব্দ কানে আসছে। সামরিক কনভয় চলার ভটভট শব্দ ভেদ করে দূর থেকে ভেসে আসছে জনতার চিৎকার। স্লোগান। তাঁকে বহনকারী গাড়ির সামনে আরেকটা ট্রাক, পেছনে আরেকটা। হেডলাইট নেভানো। শেখ মুজিব পকেট হাতড়ে লাইটার বের করলেন। ব্যথা অনুভব করলেন ডান হাতে। তাঁর বডিগার্ড মহিউদ্দিনের সঙ্গে সৈন্যদের ধস্তাধস্তির সময় মুজিব এগিয়ে গিয়েছিলেন মহিউদ্দিনকে বাঁচাতে। সৈনিকদের একজনের একটা আঘাত তাঁর ডান কাঁধে লেগেছিল। তিনি যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন, তখন সৈন্যরা ছিল ঠিক তাঁর পেছনে। তারা তাদের অস্ত্রের বাঁট দিয়ে তাঁর পেছনে আঘাত করছিল। সে সময় টের পাননি, এখন পাইপে অগ্নিসংযোগ করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, বুড়ো আঙুলে জোর পাচ্ছেন না। তিনি বাঁ হাতে লাইটারটা নিলেন। একজন মেজর বলল, নো লাইট স্যার। নো ফায়ার।

তাঁকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এরা, কে জানে! ফায়ারিং স্কোয়াডে নেওয়া হতে পারে, ফাঁসিতে ঝোলানো হতে পারে। মৃত্যু যদি আসেই, হাসিমুখে বীরের মতোই বরণ করে নেবেন তিনি, কারণ তাঁর জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তবে তিনি চান, তাঁর মৃত্যু বাংলার মাটিতেই হোক।

শেখ মুজিব তাদের মনোভাবটা আঁচ করার চেষ্টা করছেন। তারা আলো ভয় পায়। বাংলার মানুষ যদি টের পায় যে এই গাড়িতে তাদের নেতা শেখ মুজিব আছেন, তারা পতঙ্গের মতো ছুটে আসবে। তারা মরবে, তবু শেখ মুজিবকে নিয়ে যেতে দেবে না।

শেখ মুজিব তাঁর কাজ করেছেন। তিনি তাঁর ওয়্যারলেস বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছেন। ‘হয়তো এই আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ হাজি মোরশেদের কাছে ফোনকল এসেছিল। বলধা গার্ডেন থেকে বলছি, মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হক তাঁর কাজ করেছেন। আশা করা যায়, ওয়্যারলেস যন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করেছে। বার্তা প্রচারের পর তারা জানতে চেয়েছে যন্ত্র কী করব? তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যন্ত্র ধ্বংস করে পালিয়ে যেতে।

সেনাবাহিনীর এই ট্রাকটা ক্যানভাস দিয়ে ঢাকা। আকাশ দেখা যাচ্ছে না। তাঁর বাঁ পাশে বসা সৈনিকটির মুখ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু ভাবভঙ্গি থেকে অনুমান করা যাচ্ছে যে মুজিবের পাশে সে ঠিকঠাকমতো বসতে পারছে না। সংকোচ বোধ করছে। গাড়ির গতি ধীর। তাঁকে কোথায় নিয়ে যেতে চায় এরা?

মুজিবের মনে হলো, এরা তাঁকে হত্যা করবে না। তাঁর কাছে খবর ছিল, তিনি যদি পালানোর চেষ্টা করেন, তবে সেই গাড়িতে বোমা মারা হবে। গাড়িতে পলায়নরত অবস্থায় মরে পড়ে থাকবেন, এটা তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। তিনি ভেবেছেন, মারলে তাঁকে বাড়িতেই মারুক। প্রথম দফাতে যখন মারেনি, তখন তাঁকে আপাতত এরা হয়তো খুন করবে না। ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে সার্জেন্ট জহুরুল হকের মতো পেছন থেকে গুলি করে মারতে পারে কি?

আনিসুল হকের উপন্যাস ‘রক্তে আঁকা ভোর’–এর প্রচ্ছদ

আনিসুল হকের উপন্যাস ‘রক্তে আঁকা ভোর’–এর প্রচ্ছদ

আপাতত নিজের জীবন নিয়ে তিনি ভাবিত নন। নিজের জীবন, নিজের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি কমই ভেবেছেন জীবনে। এত গোলাগুলির আওয়াজ আসছে! কত মানুষই না মারা পড়ছে! বহু মানুষ রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিল। তাদের কি নির্বিচার গুলি করা হচ্ছে?

এত শব্দ কেন? এত গর্জন কেন? এত আগুন কেন? এত বোমা-বারুদ-ট্যাংক। বাংলাদেশের মানুষ তো অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি। এবার নেবে। বাঙালি পুলিশ, বাঙালি আনসারের হাতে অস্ত্র ও গোলা বিকেলের মধ্যেই তুলে দেওয়ার নির্দেশ তিনি দিয়ে রেখেছেন। বাঙালি ইপিআরও প্রস্তুত । বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করতে চায়, এই খবর তাঁর কাছে অনেকবার এসেছে। আর যদি একটা গুলি চলে…যদি বাংলার মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। নির্দেশ পরিষ্কার। ১৪ মার্চ ৩৫টি নির্দেশনা লিখিতভাবে জারি করা হয়েছিল, তাতে তো লিখিতভাবেই বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের শাসনভার হাতে তুলে নেওয়া হলো। বলা হয়েছিল, ‘আই অ্যাপিল টু দ্য পিপল টু রিমেইন রেডি ফর অ্যানি স্যাক্রিফাইস অ্যান্ড শুড ফোর্স বি আনলিশড অ্যাগেইনস্ট দেম, টু রেজিস্ট ইট বাই অলমিনস।’ ‘যদি হামলা হয়, সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করতে হবে।’

রেনু এখন কী করছে? রাসেল কি ফিডারের দুধ শেষ করতে পেরেছিল? হাসিনা, রেহানা, ওয়াজেদ মিয়া অন্য বাড়িতে। ওরা কি নিরাপদে আছে? কামাল কি এখনো রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছে? যে হারে গুলি হচ্ছে, কামাল বেঁচে থাকবে কি না সন্দেহ!

এরা কি ভেবেছে? গুলি করে আমার মানুষদের স্তব্ধ করে দেবে? এটা হয়? আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না।

গাড়ি নির্মীয়মাণ পার্লামেন্ট হাউসের সামনে এসেছে সম্ভবত। ক্যানভাসের ছাউনির নিচে দুই সৈনিকের মধ্যখানের ফোকর দিয়ে বাইরের গাছপালা-ঘরবাড়ি দেখে তিনি তাঁদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলেন। ট্রাকের সামনে-পেছনে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, লুই কানের নকশা করা পার্লামেন্ট ভবনের সামনেই তাঁরা এখন অবস্থান করছেন।

ফার্মগেটের দিক থেকে স্লোগান শোনা যেতে লাগল উচ্চ স্বরে। আর মানুষের দৌড়ের আওয়াজ। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তারের নেতৃত্ব দেওয়া লে. কর্নেল জেড এ খান প্রমাদ গুনলেন। জনতা নিশ্চয়ই শেখ মুজিবকে উদ্ধার করতে আসছে। তিনি সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, হাতিয়ার তোলো। ফায়ার করার জন্য প্রস্তুত হও।

দূর থেকেই ভেসে এল গুলির শব্দ। পায়ের আওয়াজ। জনতা পালাচ্ছে। একটু পরে জেড এ খান জানতে পারলেন, জনতা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছিল। কামান, এলএমজি, রকেট লঞ্চারের তোপের মুখে পড়িমরি পালিয়েছে। পালানোর আগে মরেছে, দৌড়ে পালাতে পালাতে পড়ে গেছে।

গাড়িবহর ক্যান্টনমেন্টের দিকে গেল না। নির্মাণাধীন অ্যাসেম্বলি ভবনের সামনে দাঁড়াল। সৈন্যরা এক সারি আগে নামল। তারপর শেখ মুজিবকে বলল, আপনাকেও নামতে হবে। মুজিব ট্রাক থেকে নামলেন। সিঁড়ির ওপরে পা রাখলেন।

সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন তাঁরা। অনেকগুলো সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না এই সিঁড়িগুলো এতটা ওপরে উঠে গেছে। একের পর এক সিঁড়ি বেয়ে ভবনের বাইরে জনচক্ষুর আড়ালে একটা জায়গা বাছাই করে থামলেন তাঁরা।

রক্তে আঁকা ভোর, আনিসুল হক, প্রকাশক: আনিসুল হক, প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা, প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২০২১ , ৫৮৪ পৃষ্ঠা, দাম: ১০৭০ টাকা।

জিপ থেকে খুলে নিয়ে আসা একটা গদি পেতে সিঁড়িতেই তাঁকে বসতে দেওয়া হলো। খোলা আকাশের নিচে তাঁরা। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। চৈত্রের আকাশে অনেক তারা। এক কোণে মেঘ। আকাশে কোনো চাঁদ নেই। বসন্তের বাতাস বইছে। বাতাসে ফুলের গন্ধ নয়, বারুদ, আগুন, ছাই, রক্তের গন্ধ। তা সত্ত্বেও ঘর্মাক্ত শরীরে এই দখিনা বাতাস যেন মমতার স্পর্শ বুলিয়ে দিতে চাইছে।

আকাশে ট্রেসার বুলেট জ্বলছে। কালো আকাশ বিদ্যুৎ-চমকিত হয়ে পুড়ে যাচ্ছে। বোমা বিস্ফোরণের শব্দে রাতের ঘুম ভেঙে কাক উড়তে শুরু করেছে আকাশে। হঠাৎ সেই আকাশে তিনি দেখতে পেলেন যেন আব্বার জ্যোতির্ময় মুখ। শেখ লুৎফর রহমান যেন তাঁকে বললেন, ‘অনেস্টি অব দ্য পারপাজ আর সিনসিয়ারিটি অব দ্য পারপাজ তোমার আছে। তুমি বিজয়ী হবে। বাংলার মানুষ বিজয়ী হবে।’

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছের ডালে বসে থাকতে পারে না। চারদিকে আগুন, চারদিকে গুলির শব্দ, চারদিকে মানুষের আর্তনাদ, মানুষের পালানোর পায়ের শব্দ। ট্যাংকের ঘর্ঘর আওয়াজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবাস লক্ষ করে কামান দাগা হচ্ছে। শিক্ষকদের কোয়ার্টারে গিয়ে নাম ধরে ধরে শিক্ষকদের ডেকে নিয়ে ব্রাশফায়ার করা হচ্ছে। জগন্নাথ হল থেকে ছাত্রদের ধরে এনে মাঠে লাইন করে দাঁড় করিয়ে চালানো হচ্ছে গুলি। জ্বলছে বস্তিগুলো। জ্বলছে ঘরবাড়ি। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশেরা ট্যাংক, কামান, রিকোয়েললেস রাইফেল, এলএমজির গোলাগুলির বিরুদ্ধে তাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করছে। আমৃত্যু মরিয়া প্রতিবাদ। জ্বলছে পিলখানা। লাশ আর লাশ। আগুন আর আগুন। গোলা আর বারুদ। নরকের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে বাংলায়। আক্রমণ চলছে বাঙালি পুলিশদের ওপর। থানায় টেবিলের ওপারে ডিউটিতে বসে থাকা পুলিশ আকস্মিক আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকছে টেবিলের ওপরেই, বহু জায়গায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঘুমন্ত সৈনিক এবং তাদের পরিবার-পরিজন নারী-শিশুদের ওপরে চালানো হচ্ছে গুলি, বিছানা-বালিশের ওপরে পড়ে থাকছে রক্তাক্ত নারী, শিশু, বৃদ্ধের লাশ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি ত্রিকালদর্শী। কিন্তু জাহান্নামের আগুনকে হার মানানো এই পরিস্থিতিতে তারাও স্তম্ভিত। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে তারা। আশ্রয় নেয় রামপুরা বিল পেরিয়ে এক হিজলগাছের ডালে। বিলের একধারে বস্তির আগুনে আকাশ লাল হয়ে আছে। আর তারই আভায় নিচে পানিতে দেখা যাচ্ছে লাশ আর রক্তের স্রোত। সেখানেই-বা ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি থাকে কী করে? তারা বলে, চলো আবার যাই বটগাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছে। বটগাছটার মায়া তারা ছাড়তে পারে না।

ব্যাঙ্গমা বলে, ‘বঙ্গবন্ধুরে গাড়িতে তুইলা মেজর জেড এ খানের মনে পইড়া যায়, তারে হুকুম দেওয়া হইছে শেখ মুজিবরে অ্যারেস্ট করার। কিন্তু ধরার পর কই লইয়া যাইতে হইব, এইটা তো কওয়া হয় নাই।’

ব্যাঙ্গমি বলে, ‘৩২ নম্বরে গোলাগুলি, বোমাবাজি কইরা শেখ মুজিবরে পাইয়াই তারা ওয়্যারলেসে জানায় দিছিল, বড় পাখিটারে পাওয়া গেছে।’

ব্যাঙ্গমা বলে, ‘লে. কর্নেল জেড এ খান শেখ সাহেবরে অ্যাসেম্বলি ভবনের সিঁড়িতে বসায়া রাইখা গেলেন ক্যান্টনমেন্টে। লে. জেনারেল টিক্কা খানের লগে দেখা করলেন। টিক্কা খান বহুত খুশদিল। শেখ মুজিবরে ধরা হইছে, সারা ঢাকা জ্বালায়া দেওয়া হইতেছে। বহুত খুব। শেখ মুজিবের ওয়্যারলেস বার্তা রেডিওতে ধরা পড়ছে, টিক্কা খানের সহকারী একটা রেডিও নিয়া ছুইটা আইছিল, স্যার স্যার শোনেন, শেখ মুজিব ওয়্যারলেসে মেসেজ দিতাছে। রেডিওতে ধরা পড়ছে। এইবার ব্যাটা নিজেই ধরা পড়ছে। মুজিবরে ধইরাই মেজর ওয়্যারলেসে জানান দিছে, বিগ বার্ড ইজ ইন দ্য কেজ।

‘জেড এ খান বুট ঠুইকা স্যালুট মারলেন। মনে মনে কইলেন, আমি হালায় গোলাগুলির মধ্যে অ্যাকশন কইরা আইলাম, আর আপনে আরাম কইরা চেয়ারে বইসা গুনগুন কইরা গান গাইতাছেন। দেই আপনের শান্তি নষ্ট কইরা।

‘টিক্কা খান জিগায়, শেখ মুজিবরে অ্যারেস্ট করছ?

‘আমি তো ঠিক শিওর না। একটা লোকরে আনছি। দেখতে মজিবরের মতন। কিন্তু মজিবরই কি না কেমনে কই? বাঙালিরা বিচ্ছু জাত, মজিবরের মতো দেখতে বসায়া রাইখা মজিবররে সরায়া রাখতে পারে।

‘টিক্কা খান সিট থাইকা ছিটকায়া পড়ল।’

টিক্কা খান পাঠালেন কর্নেল এস ডি আহমদকে। ‘যাও, দেখে এসো, ঠিকঠাক লোককে ধরা হয়েছে কি না।’

এস ডি আহমেদ গেলেন অ্যাসেম্বলি ভবনের সিঁড়িতে। চারদিকে সশস্ত্র পাহারা। তার মধ্যে জিপের সবুজ সিটে বসা দীর্ঘাঙ্গী একজন মানুষ। তার গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, পরনে সাদা পায়জামা। মুখে জ্বলন্ত পাইপ।

দেখামাত্রই এস ডি আহমেদ চিনে ফেললেন শেখ মুজিবকে।

তাঁকে সালাম জানিয়ে বললেন, ‘স্যার। আপনার এখানে তো আসার কথা প্রধানমন্ত্রী হয়ে। অথচ আপনাকে আনা হলো কয়েদি হিসেবে।’

মুজিব বললেন, ‘আমার জীবনে এটা তো নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে জিপের গদিতে বসা একটা নতুন ঘটনা!’

কর্নেল বললেন, ‘আপনি কি চা খেতে চান? আমি ব্যবস্থা করতে পারি।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

মুজিব হাসলেন। বললেন, ‘চমৎকার হবে। চা দেন। আমার জীবনে চা খাবার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর আসেনি। ওয়ান্ডারফুল। ওয়ান্ডারফুল। দিস ইজ দ্য বেস্ট টাইম অব মাই লাইফ টু হ্যাভ টি।’

কর্নেল এস ডি আহমেদ ফিরে গেলেন জেনারেল টিক্কা খানের কাছে। ঠিক লোককেই ধরা হয়েছে।

মেজর জেড এ খান বললেন, ‘স্যার, তাহলে শেখ সাহেবকে আমরা কোথায় রাখব?’

টিক্কা খান পিঠ চুলকানোর জন্য তাঁর বেতের লাঠিটা হাতে ধরলেন। বেকায়দা জায়গায় চুলকাচ্ছে। তাই তো। সব ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবকে কোথায় রাখা হবে, সেটা তো ঠিক করা হয়নি।

কর্নেল এস ডি খান বললেন, ‘স্যার। অফিসার্স মেসে রাখলে কী হয়? আগরতলা মামলায় তো সেখানেই রাখা হয়েছিল।’

‘বহুত খুব।’

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা হলো সেই মেসে। একটা রাত রাখা হলো তাঁকে সেখানে।

ভোররাতে টিক্কা খান হাঁক পাড়লেন, ‘এই কে আছিস? কর্নেল এস ডি খানকে বোলাও। আমাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে সেই পুরোনো মেসে মুজিবকে রাখা হয়েছে। জনতা যদি টের পায় মুজিব এখানে, হাজারে হাজারে আসবে, লাখে লাখে আসবে। ছিনিয়ে নিয়ে যাবে তাদের নেতাকে। সরাও তাঁকে।’

সকাল সকাল শেখ মুজিবকে তারা সরিয়ে নিল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আদমজী স্কুলে।

হেডমাস্টারের রুমে আনা হলো তাঁকে। রুমে একটা ইজিচেয়ার আছে। বড় টেবিল আছে। সামনে বসার জন্য অনেকগুলো হাতলওয়ালা চেয়ার আছে। কিন্তু কোনো বিছানা-বালিশ নেই। বাথরুম নেই।

লন্ডনের ক্ল্যারিজেস হোটেলে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২

লন্ডনের ক্ল্যারিজেস হোটেলে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২

অফিসার বললেন, ‘স্যার, আপনি এই ইজিচেয়ারে আরাম করুন। আমরা বিছানা-বালিশের ব্যবস্থা করছি।’

মুজিব বললেন, ‘আরাম করব?’

‘ইয়েস স্যার।’

মুজিব বললেন, ‘শোনেন অফিসার। আপনি হুকুমের চাকর। আপনাকে আমি কিছু বলব না। শুধু একটা কথা আমি বলি। এই জীবনে অত্যাচার আমি অনেক সহ্য করেছি। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে জুলুম করছেন। কিন্তু আমি অপমান সইতে পারি না। আপনারা বাঙালিদের শুধু জুলুম করেন নাই, অপমানও করেছেন। এর শাস্তি আপনারা পাবেন। সমস্ত বাংলাদেশ কামান, ট্যাংক, বন্দুকের বোমা, গোলা, আগুনে ধ্বংস করে দিয়ে আপনি বলছেন আমাকে ইজিচেয়ারে আরাম করতে। আপনি যদি আমার সামনে থেকে সরে যান, কেবল তাহলেই আমি আরাম পেতে পারি। বুঝেছেন?’

‘ইয়েস স্যার।’ স্যালুট দিয়ে অফিসার রুম থেকে বিদায় নিলেন।

বাথরুম এই রুমের বাইরে, টানা বারান্দার মাথায়। শেখ মুজিব রুম থেকে বের হয়ে বাথরুমে যাচ্ছেন। হঠাৎই চিৎকার, ‘মামা গো!’

একটা ঘর থেকে এই নারীকণ্ঠের চিৎকার আসছে। ঘরের জানালা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে শেখ মুজিব দেখতে পেলেন, আম্বিয়ার মা ‘ও মামা গো’ বলে গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করছে। ভেতরে আরও আছে রমা, ফরিদ, নিয়াজ, আজিজ মিয়া-তাঁর বাড়ির কাজের লোকেরা। মুজিব রেগে গেলেন। সেন্ট্রিদের বললেন, ‘এই, তোমাদের অফিসার কে আছে, ডাকো তো এক্ষুনি।’

অফিসার এলেন। মুজিব রাগতস্বরে ইংরেজিতে বললেন, ‘আমাকে এনেছ এনেছ। তোমরা আমার বাড়ির কাজের লোকদের কেন এনেছ? এই বুড়িকে আনার মানে কী? এক্ষুনি এদের ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।’

২৮ মার্চ একটা ট্রাকে করে বাড়ির গৃহকর্মীদের তুলে নিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়। মিরপুর রোডে, আইয়ুব গেটের কাছে।

ব্যাঙ্গমা বলে, ‘বিবিসি লন্ডন ২৬ মার্চ রাত দশটায় এই খবর প্রচার করে।’

ব্যাঙ্গমি বলে, ‘খবরটা ইংরেজি। তুমি বাংলা কইরা শোনাও।’

ব্যাঙ্গমা বাংলায় বিবিসির ২৬ মার্চের খবর শোনায়:

বিবিসি লন্ডন। ২৬ মার্চ ১৯৭১। এ.৪৩। ২২.০০ পাকিস্তান-ওয়ান।

ইয়াহিয়া খান তাঁর সরকারের কতৃর্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার পর এবং ভারত থেকে পাওয়া খবর অনুসারে শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশকে স্বাধীন বলে ঘোষণা দেওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক যুদ্ধের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকায় আমেরিকান কনসাল জেনারেল বলেন, বিদ্রোহ দমনের জন্য ট্যাংক ব্যবহার করা হয়েছে। ভারত থেকে পাওয়া আগের খবর হলো, একটা গুপ্ত বেতার থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.