ধান কাটার গান

0
208
ধান কাটতে কাটতে গান গাইছিলেন। ক্যামেরায় ক্লিক করতেই হেসে দিলেন আবু বাক্কার। সম্প্রতি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ফুলবাড়ী মাঠে

‘ও কি খুলনার নাহরি তুমি ভাবিয়া করছ কী/ ধান বেচিয়া কিন্যা আনব তোমার ফুলতোলা শাড়ি।’ কাটা ধানের আঁটি বাঁধতে বাঁধতে ভাওয়াইয়ার সুরে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর ফুলবাড়ী গ্রামের মাঠে গানটি গাইছিলেন কৃষিশ্রমিক আবু বাক্কার।

পাবনা–রাজশাহীর জলপথে নৌকাভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ এমন একটি গান শুনেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লোকসাহিত্য গ্রন্থের ‘গ্রাম্য সাহিত্য’ প্রবন্ধে বলেছেন, এক দল লোক বাঁশের বাখারি দিয়ে বইঠা বাইতে বাইতে গান গেয়ে যাচ্ছিলেন। ‘যুবতী ক্যান বা কর মন ভারী/ পাবনা থ্যাহে আন্যে দেব ট্যাহা দামের মোটরি।’ ফুলতোলা শাড়ি আমাদের পরিচিত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোটরি জিনিসটা কী, তা বুঝে উঠতে পারেননি। তা না পারলেও বলেছেন, ‘গানের এই দুটি চরণে সেই শৈবালবিকীর্ণ জলমরুর মাঝখান হইতে সমস্ত গ্রামগুলি যেন কথা কহিয়া উঠিল।’

আবু বাক্কার অন্য কোনো অঞ্চল থেকে রাজশাহীতে আসেননি। এ গান কোনো ওস্তাদের কাছেও শেখেননি। গানটি যে আবার রাজশাহী অঞ্চলেরও নয়, গানের কথাই সেটা বলে দিচ্ছে। গানের শুরুতেই বলা হয়েছে ‘খুলনার নাহরি (নায়রি)’–এর কথা।

গোদাগাড়ীর আবু বাক্কারের গানেও যেন বিস্তীর্ণ ধানের খেত কথা কয়ে উঠল। বাইরের কথায় দুটি গান কিছুটা আলাদা হলেও ভেতরে কোথায় যেন মিল রয়েছে। থমকে দাঁড়িয়ে কান পাততে হলো। কিষান তাঁর কিষানি বধূর মন ভরাতে গানে গানে ধান বেচে ফুলতোলা শাড়ি কেনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। হয়তো তাঁর ঘরে আছে খুলনার নায়রী। রবীন্দ্রনাথ গানের সূত্র ধরে বলেছেন, ‘জগতে যত প্রকার দুর্বিপাক আছে, যুবতীচিত্তের বিমুখতা তার মধ্যে অগ্রগণ্য।’ তাঁর মন ভালো করার জন্য শাড়ি কেনার প্রতিশ্রুতি আছে এই গানে।

মাঠে-ঘাটে আজকাল আর এ রকম গান শোনা যায় না। রাখালের চিরন্তন বাঁশি বাজে না। বিদায় নিয়েছে গরুর গাড়ি। গরুর গাড়ির সঙ্গে বিদায় নিয়েছে গাড়োয়ানের গানও। গরুর গাড়ির জায়গা দখল করে নিয়েছে শ্যালো ইঞ্জিনে চালানো ভটভটি। তার শব্দের হুংকারে ঢাকা পড়ে গেছে মেঠোপথের গান। কৃষি যন্ত্রায়ণও মাঠে নিয়ে এসেছে ইঞ্জিনের শব্দ। এত শব্দের মধ্যে কৃষকের মুখের গান গেছে মিলিয়ে। সুনির্দিষ্ট করে ধান কাটার গানও তেমন শোনা যায় না।

তিনি এই গানের শুধু পরের দুটি চরণ গাইতে পারেন। ‘ওই শাড়ি পইরা যাইবা তুমি বাবা-মার বাড়ি/ ওরে গ্রামের লোকে দেইখ্যা বলবে তোমায় খুলনার নাহরি।’

বাংলা সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির গবেষক শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর বঙ্গীয় লোক-সঙ্গীত রত্নাকর বইয়ে ধান কাটার গান নিয়ে বলেছেন, খেতে পাকা ধান কাটার সময় কোনো কোনো অঞ্চলের কৃষকদের একসঙ্গে যে গান গাইতে শোনা যায়, তাঁকে ধান কাটার গান বলা হয়। এ গানকে তিনি ফেলেছিলেন কর্মসংগীতের গোত্রে। এ–ও বলেছেন, এই শ্রেণির গান বিশেষ শুনতে পাওয়া যায় না। ‘প্রামাণিকতা সংশয়াতীত নহে’ উল্লেখ করে তিনি একটি গানের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, ‘হারে আমার কাতিশাল, বছর বছর থাকিস রে বহাল…।’

সেদিন গোদাগাড়ীর ফুলবাড়ীর মাঠে শ্রমিক আবু বাক্কারের গান তাই মুহূর্তটিকে সোনারঙে উজ্জ্বল করে মূল্যবান করে তুলল। তিনি এই গানের শুধু পরের দুটি চরণ গাইতে পারেন। ‘ওই শাড়ি পইরা যাইবা তুমি বাবা-মার বাড়ি/ ওরে গ্রামের লোকে দেইখ্যা বলবে তোমায় খুলনার নাহরি।’

আবু বাক্কার গান গাইছেন। আর তাঁর পেছনে বিস্তৃত সোনালি ধানের খেত সুদূর সবুজ রেখায় গিয়ে মিশেছে। সেই মাঠ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাঁর গান। গানটি মনে জাগিয়ে তুলল উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘দ্য সলিটারি রিপার’ কবিতার মাঠে একাকী তরুণীর গান গেয়ে শস্য কাটার চিত্র।

গাওয়া শেষে গানের কথা নিয়ে আলাপ হলো আবু বাক্কারের সঙ্গে। আবু বাক্কারের বয়স ষাটের কাছাকাছি। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল রাজশাহীর পবা উপজেলার বেড়পাড়া গ্রামে। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এরপর তাঁরা পাশের গোদাগাড়ী উপজেলার শেখেরমারি গ্রামে বসতি গড়েন। সেই পবার দামকুড়া গ্রামে তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন।

আবু বাক্কার অন্য কোনো অঞ্চল থেকে রাজশাহীতে আসেননি। এ গান কোনো ওস্তাদের কাছেও শেখেননি। গানটি যে আবার রাজশাহী অঞ্চলেরও নয়, গানের কথাই সেটা বলে দিচ্ছে। গানের শুরুতেই বলা হয়েছে ‘খুলনার নাহরি (নায়রি)’–এর কথা। গানটি খুলনা অঞ্চলের লোকগান হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আবু বাক্কারের যতটুকু মনে পড়ে, ১৯৮০ সালের দিকে তিনি রেডিওতে এই গান শুনেছিলেন। তখনই গানের কয়েকটি চরণ তাঁর মনে গেঁথে গেছে।

আবু বাক্কারের গলার স্বর সুরেলা। এই বয়সেও মুখে কৌতুকের হাসি। এই গানই ছিল কিষানের একসময়কার কাজের আনন্দ। ফিরে আসার সময় মনে হলো, যে কৃষক ধান বেচে বউকে ফুলতোলা শাড়ি কিনে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, সেই ধানই তো তাঁর স্বপ্ন দেখার বীজ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.