এক বছরের ছোট্ট শিশু শেখ মাহতাব উদ্দিনের বাবা শেখ মহিন উদ্দিন মাছ বিক্রি করেন। ১০ দিন আগে (৬ অক্টোবর) রাত সাড়ে ১১টার দিকে মাছ বিক্রির জন্য ঢাকার দক্ষিণখান থেকে আবদুল্লাহপুরে যান তিনি। দোতলা বাসার নিচতলার একটি কক্ষে শেখ মাহতাবকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন মা ইসরাত জাহান। রাত দুইটার পর তিনি ছিলেন রান্নাঘরে। তাঁর ছেলে মাহতাব তখন গভীর ঘুমে। হঠাৎ রাত তিনটার দিকে ছেলের চিৎকার শুনতে পান ইসরাত। ঘরের আলো জ্বেলে দেখতে পান, মাহতাবের পেটের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে গেছে। পরে তাঁকে উদ্ধার করে আবদুল্লাহপুরের স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরে শিশুটির বাবা শেখ মহিন উদ্দিন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে খুনের মামলা করেন। এই খুনে জড়িত সন্দেহে পুলিশ শিশুটির সৎদাদি উম্মে হাবিবা আফরিন (৩৫), আফরিনের মা নিলুফা বেগম (৬০) ও ভাই কাজী সিয়ামকে (২০) গ্রেপ্তার করেছে। এই তিনজনকে কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।
গত ২৭ জুলাই শিশু মাহতাব অসুস্থ হলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সে সময় তার দুধের সঙ্গে বিষজাতীয় কিছু মেশানো হয়েছিল বলে পুলিশ ও শিশুটির মা–বাবা জানিয়েছেন।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ ইয়াসীন গাজী আজ সোমবার বলেন, এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে মনে হয়েছে, শিশু মাহতাব খুনের সঙ্গে তার সৎদাদি উম্মে হাবিবা, তাঁর ভাই সিয়াম জড়িত। দুই দফায় উম্মে হাবিবাসহ তিনজনকে পাঁচ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
অপর দিকে উম্মে হাবিবাদের আইনজীবী জিয়াদুল ইসলাম বলেন, একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিরোধের জেরে গত জুলাই থেকে উম্মে হাবিবা স্বামীর বাসা ছেড়ে বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন। কোনোভাবে তিনি বা তাঁর মা-ভাইয়েরা শিশু মাহতাব হত্যার সঙ্গে জড়িত নন।
‘দুধে বিষ দেওয়া হয়েছিল শিশুটিকে’
শিশু মাহতাবের মা–বাবা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মাহতাবের দাদার নাম মাহবুবুর রহমান। পেশায় তিনি গাড়িচালক। দক্ষিণখানের ফায়দাবাদ উত্তরপাড়ায় দোতলা একটি বাড়ির মালিক তিনি। তিন বছর আগে (২০২০ সালের ৩০ জুলাই) তাঁর প্রথম স্ত্রী শাহিদা আক্তার মারা যান। স্ত্রীর মৃত্যুর ছয় মাসের মাথায় উম্মে হাবিবাকে বিয়ে করেন মাহবুবুর রহমান। পরে দক্ষিণখানের বাসায় স্বামীর সঙ্গে বসবাস শুরু করেন হাবিবা। একই বাসায় মাহবুবুরের বড় ছেলে শেখ মহিন তাঁর স্ত্রী ইসরাত, মেয়ে সিরাতুল মুলতাহা ও শেখ মাহতাবকে নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। গত ২৭ জুলাই শিশু মাহতাব অসুস্থ হলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সে সময় তার দুধের সঙ্গে বিষজাতীয় কিছু মেশানো হয়েছিল বলে পুলিশ ও শিশুটির মা–বাবা জানিয়েছেন।
দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক মোহাম্মদ ইয়াসীন গাজী বলেন, ফিডারে বিষ মেশানো দুধ পান করানোর অভিযোগ ওঠে উম্মে হাবিবার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তখন সালিস বসে। পরে উম্মে হাবিবা স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাবার বাড়িতে থাকা শুরু করেন। এর মধ্যে ৬ অক্টোবর শিশু মাহতাবকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তা ইয়াসীন গাজী বলেন, উম্মে হাবিবাসহ অন্যদের নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, তিন বছর আগে মাহতাবের দাদা মাহাবুবুরের সঙ্গে উম্মে হাবিবার বিয়ের পর পারিবারিক অশান্তি শুরু হয়। মাহতাব ও তার বড় বোন সিরাতুলকে অত্যধিক স্নেহ করতেন দাদা মাহবুবুর। এতে উম্মে হাবিবা স্বামীর ওপর ক্ষিপ্ত হতেন। হাবিবা একাধিকবার মাহবুবুরকে বলেছিলেন, তিনি সন্তান নিতে চান। কিন্তু মাহবুবুর তাতে রাজি ছিলেন না।
পারিবারিক বিরোধের জের ধরে উম্মে হাবিবার পরিকল্পনায় শিশু মাহতাবকে খুন করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন পরিদর্শক ইয়াসীন গাজী।
অভিযোগের বিষয়ে উম্মে হাবিবার আইনজীবী বলেন, দুধের সঙ্গে বিষ মেশানোর মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাঁর মক্কেল উম্মে হাবিবাকে বাড়ি থেকে তাড়ানো হয়েছে। এরপর তাঁর ওপর মাহতাব খুনের দায় চাপানো হচ্ছে। বাস্তবে মাহতাবকে উম্মে হাবিবা বা তাঁর ভাই সিয়াম খুন করেনি। খুন করেছে অন্য কেউ।
দক্ষিণখান থানা-পুলিশ লিখিতভাবে আদালতকে জানিয়েছে, স্বামীর বাসা থেকে উম্মে হাবিবা চলে যাওয়ার পর তাঁর ভাই সিয়াম মাহতাবের পরিবারের সদস্যদের নানা হুমকি দেন।
যে–ই শিশু মাহতাবকে খুন করুক, তার ন্যায্য বিচার চান মা ইসরাত জাহান। তিনি বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে আমার মাহতাবকে খুন করা হয়েছে। আমি ছিলাম রান্নাঘরে। ঠিক তখনই, জানালার ফাঁক গলে ধারালো কিছু দিয়ে পেটে আঘাত করে পালিয়ে গেছে খুনি।’
মাহতাব খুন হওয়ার সময় মেয়ে সিরাতুল মুনতাহা নানা বাড়িতে ছিল বলে জানান এই শিশুদের বাবা শেখ মহিন উদ্দিন। তিনি আজ বলেন, ‘মুনতাহা এখন রোজ রাতে ঘুমানোর সময় আমাকে বলছে, বাবা, মাহতাব কোথায়? আমি কোনো জবাব দিতে পারি না।’ সন্তানের ঘাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।