তাপপ্রবাহ প্রাণঘাতী জেনেও সবাই চুপ

0
89

জীবিকার খোঁজে বছর দুয়েক আগে রাজধানী ঢাকায় পা রাখেন হবিগঞ্জের লাখাইয়ের অজপাড়াগাঁয়ের আবদুল আউয়াল। শনির আখড়ার এক গ্যারেজ থেকে রিকশা ভাড়া নিয়ে চালাতেন। প্রবল গরমেও রিকশা চালাতে গিয়ে চেতনা হারিয়ে গত সোমবার মারা যান আউয়াল। যাত্রাবাড়ীর কাজলা পশ্চিম শিবির নয়ানগর এলাকার আলমগীর শিকদার (৫৬) বই বাঁধাইয়ের কাজ করতেন। গতকাল গুলিস্তানে কড়া রোদে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে রাস্তায় পড়ে মারা যান তিনি।

আগে যেখানে শৈত্যপ্রবাহে মানুষ মারা যেত বেশি, এখন সেখানে তাপপ্রবাহে দেখা যাচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। গত শুক্রবার থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত পাঁচ দিনে তাপপ্রবাহে অন্তত ২৯ জন মারা যাওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। তীব্র তাপপ্রবাহের দিনগুলোতে মৃত্যু বেড়ে যায় ২২ শতাংশ। দেশের পাঁচটি প্রধান নগরের ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রবল তাপের ঝুঁকিতে আছেন। গরমে অধিক শ্রমে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন অনেকে। প্রতিবছর ঢাকা প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার শ্রম উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে। অথচ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের মতো তাপপ্রবাহকে আমলেই নিচ্ছে না। এত মৃত্যু, এত ক্ষতির পরও তাপপ্রবাহকে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ হিসেবে এখনও ঘোষণা করা হয়নি। ফলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তাপপ্রবাহ নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা, নীতি ও বাজেট তৈরি করেনি। তাপমাত্রা কমাতেও নেই তেমন কর্মসূচি। অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেভাবে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে থাকা মানুষের পাশে নেই কেউ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপপ্রবাহকে আর হেলাফেলা করার উপায় নেই। কয়েক বছর ধরে তাপমাত্রা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হবে। এখনই তাপপ্রবাহকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় নীতি ও পরিকল্পনা নিতে হবে।

হুমকিতে জীবন-জীবিকা
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের পাঁচ প্রধান নগরের ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রবল গরমে বিপর্যস্ত। নগরগুলো হলো– ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট। এর মধ্যে ঢাকার ৭৮ শতাংশ বা ১ কোটি ২৫ লাখ মানুষ এ ঝুঁকিতে রয়েছেন। ৯ বছরের কম ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ গরমের কারণে সবচেয়ে বেশি শারীরিক সমস্যায় পড়ছে। জলবায়ু ও পরিবেশ গবেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও আবহাওয়ার পরিবর্তন ছাড়াও শহরে দ্রুত দালানকোঠাসহ সব ধরনের ভৌত অবকাঠামো ও জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে তাপপ্রবাহ বাড়ছে।

ইউনিসেফের সহায়তা নিয়ে উষ্ণতাজনিত অসুস্থতা চিকিৎসার নির্দেশিকা তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাতে বলা হয়েছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তাপপ্রবাহের সময় ২২ শতাংশ মৃত্যু বেশি হয়। গবেষকরা অবশ্য এ হিসাবের মধ্যে মাতৃমৃত্যু ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুকে অন্তর্ভুক্ত করেননি। ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে তাপের কারণে দেশে ১ থেকে ৩ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছিল।

কৃষি ও নির্মাণশিল্পে কায়িক শ্রমের সঙ্গে জড়িতদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ওপর এমন দমবন্ধ করা তাপমাত্রা যে কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, সে বিষয়টিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে ঢাকার বাসিন্দারা বিপজ্জনক আবহাওয়ার মধ্যে বাস করছেন। এতে শ্রমঘন এ নগরের মানুষের উৎপাদনক্ষমতা কমছে। উল্টো বাড়ছে অর্থনৈতিক ক্ষতি। প্রতিবছরে ঢাকা প্রায় ৬০০ কোটি ডলার বা ৬০ হাজার কোটি টাকার শ্রম উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে।

অতিরিক্ত তাপের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১৮ হাজার ৯৭০ জন শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। গত সোমবার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রকাশিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, চরম আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশ, ভারত, লাওসসহ অনেক অঞ্চলে গত বছরের এপ্রিলে রেকর্ড পরিমাণ উচ্চ তাপমাত্রা দেখা গেছে। এ ধরনের আবহাওয়াকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, চরম আবহাওয়ায় বাংলাদেশ, ফিলিপাইন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, হতাশা, মাদকাসক্তি, আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।

হাত গুটিয়ে বসে আছে সবাই
যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের নানা কর্মসূচি থাকে। কিন্তু তাপপ্রবাহ নিয়ে তাদের নেই কোনো কর্মসূচি। দেশের কৃষি, ডেইরি, পোলট্রি ও মৎস্য খাতে বিপর্যয় নেমে এলেও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জন্য নেই প্রণোদনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও গণমাধ্যমে কিছু পরামর্শবার্তা দিয়েই দায় সারছে স্বাস্থ্য, কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। একই অবস্থা সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার। এসব সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, তাপপ্রবাহকে এখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হয়নি। ফলে নীতি ও পরিকল্পনা নেওয়ার সময় অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তাপপ্রবাহের মতো প্রাণঘাতী দুর্যোগ থেকে যায় আড়ালে। শুধু সরকারি সংস্থা নয়; স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও তাপসহনীয় হিসেবে গড়ে উঠছে না।

ঢাকা নগরের তাপমাত্রা কমানোর উদ্যোগ হিসেবে দুই বছরে দুই লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। গত বছর তাঁর এ ঘোষণার পরও তেমন গাছ লাগাতে দেখা যায়নি। উল্টো দুই সিটির বিভিন্ন সড়কদ্বীপে গাছ কাটা হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের এক সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, আট বছরের ব্যবধানে ঢাকায় সবুজ ও ফাঁকা জায়গার পরিমাণ ১৬ থেকে ২০ শতাংশ কমেছে।

ঢাকার বাতাসে থাকা পাঁচ ধরনের ক্ষতিকর গ্যাস উত্তাপ বাড়ালেও পরিবেশ অধিদপ্তরের এ নিয়ে কোনো গবেষণা, প্রকল্প কিংবা সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেই। দূষণ নিয়ে নানা প্রকল্প থাকলেও তাপ কমানো নিয়ে সংস্থাটির নেই কোনো কর্মসূচি। অবশ্য গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি চলমান প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মধ্যে নিয়মিত রাস্তায় পানি ছিটানো এবং উপজেলা পর্যায়ে জনগণের মধ্যে স্যালাইন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য সুপারিশ করেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান বলেন, ‘তাপপ্রবাহের বিষয়ে সার্বিকভাবে সবার সচেতনতার অভাব আছে। তাপপ্রবাহ অবশ্যই বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কারণ, এখানে জীবনের ঝুঁকি আছে। সরকারও এ ব্যাপারে চিন্তা করছে।

বায়ুমণ্ডল দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘তাপমাত্রা বাড়লে গাছ লাগানো নিয়ে নানা কথাবার্তা হয়। বছরের বাকি সময় আর খবর থাকে না। তাপপ্রবাহ নিয়ে সব সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। একজন হিট অফিসার নিয়োগ ছাড়া তাপপ্রবাহকে ঘিরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরের কাজ নেই। ঢাকায় চার দিনের জাতিসংঘ জলবায়ু অভিযোজন সম্মেলন ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান এক্সপো চলছে। সেই সম্মেলনেও তাপের কারণে কী ক্ষতি হচ্ছে কিংবা ভবিষ্যতের ঝুঁকির বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই। রাষ্ট্রের যত পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সবকটিতেই জলবায়ু পরিবর্তন বলতে উপকূলকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাপমাত্রার কারণে যে নগরের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে, তা স্পষ্ট করা হয়নি। জাতীয়ভাবে জরুরি ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে নিয়ে একটি শক্তিশালী কমিটি করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।’

কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, ‘অনেক দেশেই এখন তাপপ্রবাহকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের দেশগুলো তাপপ্রবাহ চলাকালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আশ্রয়শিবির চালু করে; যেখানে ঘরহীন মানুষ আশ্রয় নেন। বিভিন্ন ফুড-ব্যাংক থেকে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করা হয়। বাংলাদেশও একই ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে। তাপপ্রবাহের সময় জারি করা যেতে পারে আবহাওয়াজনিত জরুরি অবস্থা। বন্যা, শীত, ঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি কমানো ও দুর্গত মানুষের জন্য যেমন সরকারের বরাদ্দ থাকে, তেমনি তাপপ্রবাহ নিয়েও নতুন পরিকল্পনা নিতে হবে। দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠী তাপপ্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। এ জন্য সরকারের গুরুত্ব দিতে হবে পরিকল্পনা ও বরাদ্দের বিষয়টি।’

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধরে রাখার পাশাপাশি এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় শহরে গাছপালা ও জলাভূমি বাড়ানোর বিকল্প নেই।’

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘তাপপ্রবাহের কারণে এখন নগর বনায়নের দিকে আমরা নজর দিয়েছি। নগর বনায়ন করা গেলে ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা কমানো যেতে পারে। ঢাকার তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম উৎস আশপাশের ইটভাটা বন্ধ করা হচ্ছে; দূষণ কমাতেও চলছে নানা উদ্যোগ। সামনের পরিকল্পনায় তাপপ্রবাহকে আরও গুরুত্ব দেওয়া হবে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.