ঢাকায় আসছে নতুন প্রযুক্তি, উড়োজাহাজে ওঠার আগেই ধরা পড়বেন অপরাধী

0
202
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তি অ্যাডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন সিস্টেম (এপিআইএস) নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ভূমিকা রাখা যাবে বলে আশা বেবিচকের। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর ৪০ লাখের বেশি আন্তর্জাতিক যাত্রী ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এই যাত্রীদের মধ্যে অপরাধী, মানব পাচার বা মাদক চোরাকারবারি থাকলে শনাক্ত করা কঠিন। কিন্তু এপিআইএসের মাধ্যমে এসব অপরাধী শনাক্ত করা সহজ হবে।

এপিআই সিস্টেম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অপরাধীদের তালিকার সঙ্গে উড়োজাহাজের যাত্রীদের নাম-ঠিকানা যাচাই-বাছাই করে নেবে। নাম, নামের বানান, নামের অংশবিশেষ বা নামের বানানের বৈচিত্র্যও বিবেচনায় নেওয়া হবে। ফলে সন্দেহভাজন কাউকে পেলেই সেই তথ্য ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেবে এপিআইএস।

মূলত এপিআইএসের মাধ্যমে অন্য দেশের কোনো বিমানবন্দর থেকে আসা একটি ফ্লাইটের সব ক্রু ও যাত্রীর বায়োমেট্রিক উপাত্ত এবং ফ্লাইটসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তথ্য সংগ্রহের কাজটি টিকিট কাটার সময়ই হয়ে যাবে। এরপর উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের আগেই সেই তথ্য এপিআইএসের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের হাতে চলে আসবে। এপিআইএস থেকে তথ্য ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে যাওয়ার আগেই উড়োজাহাজের সব আরোহীর তথ্য-উপাত্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করা হবে। বিশ্লেষণের জন্য এপিআই সিস্টেমটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অপরাধীদের তালিকার সঙ্গে উড়োজাহাজের যাত্রীদের নাম-ঠিকানা যাচাই-বাছাই করে নেবে। নাম, নামের বানান, নামের অংশবিশেষ বা নামের বানানের বৈচিত্র্যও বিবেচনায় নেওয়া হবে। ফলে সন্দেহভাজন কাউকে পেলেই সেই তথ্য ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেবে এপিআইএস।

একইভাবে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে কোনো অপরাধী দেশ ছাড়তে চাইলে বোর্ডিং পাসের আগেই তাঁর তথ্য ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেবে এপিআইএস।

এপিআইএস বাস্তবায়ন ও ব্যবহারের খরচ কত হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে বেবিচক সূত্র বলছে, এটি বাস্তবায়নে ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা খরচ হতে পারে। আমিরাতস টেকনোলজিস এই টাকা বিনিয়োগ করবে। এর বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিবছর নির্দিষ্ট হারে ফি দেবে বেবিচক।

বেবিচক বলছে, এপিআইএস বাস্তবায়ন হলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস, অপরাধীদের দেশত্যাগ বা দেশে প্রবেশ, মানব পাচার, মাদক চোরাচালান ও মানি লন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ প্রতিরোধ করা সহজ হবে। এ ছাড়া বিমানবন্দরে আগমনকারী যাত্রীদের তথ্য আগাম হাতে পাওয়ায় সাধারণ যাত্রীরা ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসসংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা দ্রুত শেষ করতে পারবেন।

বেবিচকের তথ্য অনুযায়ী, ইমিগ্রেশন পুলিশ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগ, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, জাতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এপিআই সিস্টেমের তথ্য ব্যবহার করতে পারবে।

বেবিচকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আকাশপথে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও অপরাধের বিস্তারের পাশাপাশি যাত্রী সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। এতে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাসমূহের ওপরও চাপ বাড়ছে। তাদের ব্যস্ততার কারণে নিরাপত্তা ফাঁকি দিয়ে আন্তঃদেশীয় অপরাধসহ চোরাচালান বন্ধ করে বিমানবন্দর ও সার্বিকভাবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

এই প্রযুক্তি কেন প্রয়োজন

বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) সদস্য। সংস্থা দুটির নির্দেশনা অনুযায়ী, আন্তঃদেশীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ এপিআইএস প্রযুক্তি বাস্তবায়নে বাধ্য। না হলে আন্তর্জাতিকভাবে ফ্লাইট পরিচালনায় নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে।

তাই বাধ্যবাধকতা পূরণ ও অপরাধ মোকাবিলার অংশ হিসেবে ২০১‍৬ সালে জাতীয় বেসামরিক বিমান চলাচল নিরাপত্তা কমিটির সভায় এপিআইএস বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরের বছর এ–সংক্রান্ত একটি সেল এবং ২০১৮ সালে যৌথ কারিগরি উপকমিটি গঠন করা হয়। ২০১৯ সালে এপিআইএস বাস্তবায়নের জন্য দরপত্র আহ্বান করে বেবিচক। কানাডা, ফ্রান্স ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশগ্রহণের আগ্রহ দেখায়। পরে দরপত্রে না গিয়ে জিটুজির মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় বেবিচক।

আন্তর্জাতিক পথে যাত্রীপ্রতি (আসা-যাওয়া) এপিআইএস ব্যবহারের ফি হিসেবে সাড়ে তিন ডলার আরোপ করা হতে পারে। এই ফি যাত্রীদেরই পরিশোধ করতে হবে।

এ সময়ও কানাডা ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব আসে। কিন্তু ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় কানাডার প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। এর ধারাবাহিকতায় গত ২৮ ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আমিরাতস টেকনোলজিস সল্যুশনসের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে বেবিচক। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, আমিরাতস টেকনোলজিস এপিআই পদ্ধতি স্থাপনের জন্য বহুজাতিক কোম্পানি সিটার প্রযুক্তি ও সফটওয়্যার ব্যবহার করবে।

এপিআইএস ব্যবহারের খরচ

এপিআইএস বাস্তবায়ন ও ব্যবহারের খরচ কত হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে বেবিচক সূত্র বলছে, এটি বাস্তবায়নে ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা খরচ হতে পারে। আমিরাতস টেকনোলজিস এই টাকা বিনিয়োগ করবে। এর বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিবছর নির্দিষ্ট হারে ফি দেবে বেবিচক।

প্রাথমিক আলোচনা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক পথে যাত্রীপ্রতি (আসা–যাওয়া) এপিআইএস ব্যবহারের ফি হিসেবে সাড়ে তিন ডলার আরোপ করা হতে পারে। এই ফি যাত্রীদেরই পরিশোধ করতে হবে। বেবিচকের প্রাক্কলন অনুযায়ী, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য দুই বছর সময় লাগতে পারে। আর বেবিচকের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠানের আট বছরের চুক্তি হতে পারে। এই সময়ে বছরে আন্তর্জাতিক যাত্রীর (আগমনী) সংখ্যা হতে পারে প্রায় ৪৭ লাখ। সে অনুযায়ী, ফি হিসেবে এসব যাত্রীর কাছ থেকে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হতে পারে। এর মধ্যে বেবিচকের কোষাগারে কত টাকা জমা হবে আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠানকে কত দেওয়া হবে, সেটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেবিচকের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মোট ফির ২০ শতাংশ বেবিচক পাবে। তিনি আরও বলেন, আমিরাতের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিনিয়োগ না করে বেবিচক নিজে বিনিয়োগ করলে আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল।

জানতে চাইলে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, এপিআইএস বাস্তবায়নের জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। তারা (আমিরাতস টেকনোলজিস) একটি কারিগরি প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এরপর প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে আর্থিক বিষয়ের প্রস্তাব দেওয়া হবে। সেটি যাচাই-বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত চুক্তি হবে। এরপর এপিআইএস বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

সাদ্দাম হোসাইন

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.