অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা আয়োজন করবেন, তা জানতে ঢাকা আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জিয়া। আগামী নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা হবে কিনা, তা যাচাই করতে আসছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দল। সেই সঙ্গে জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে আসছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমোন গিলমোর। তবে অর্থনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি হোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজের ঢাকা সফর এখনও শর্তের বেড়াজালে আটকে রয়েছে। ফলে জুলাই মাসেই মিলতে পারে বাংলাদেশের আগামী কয়েক মাসের রাজনৈতিক গতিপথের পূর্বাভাস। কূটনৈতিক সূত্রে এ তথ্যগুলো জানা গেছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, উজরা জিয়ার সফরটি নিশ্চিত। তবে হোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজের ঢাকা সফর এখনও নিশ্চিত হয়নি। হোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজের ঢাকা সফরের সঙ্গে বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। সেগুলো পূরণ হলেই বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ পর্যায়ের অর্থনৈতিক সংলাপে যোগ দিতে তিনি আসবেন। এক্ষেত্রে শ্রম আইনটি সংশোধনের শর্তটি অন্যতম।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওই কর্মকর্তা বলেন, মানবাধিকার বিশেষ করে শ্রম অধিকার গুরুত্ব পাবে উজরা জিয়ার বৈঠকে। সম্প্রতি শহিদুল ইসলাম নামে এক শ্রমিকের হত্যার বিষয়ে ইতোমধ্যে নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম দপ্তর। এছাড়া শ্রমিকদের নিয়ে বৈশ্বিক অধিকার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান একদম নিচে। ফলে অধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে আলোচনা করবে দুই দেশ। আগামী ১১ জুলাই ঢাকা আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জিয়া। তাঁর বৈঠকে গুরুত্ব পাবে শ্রম পরিস্থিতি, নাগরিক সমাজের স্থান সংকোচন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি। উজরা জিয়ার নেতৃত্বে সফরে মার্কিন প্রতিনিধি দলে পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু’ও থাকবেন। এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি চূড়ান্ত না হলেও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, শ্রমিক প্রতিনিধি ও গণমাধ্যমের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে।
বাংলাদেশের শ্রম অধিকার, পরিবেশ ও মান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ এক যুগের ওপর। মোটাদাগে শ্রম পরিস্থিতির ৬-৭টি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ রয়েছে। চলতি সংসদ অধিবেশনে সেগুলোকে দূর করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়গুলোতে দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়ার কিছুটা অসন্তুষ্ট যুক্তরাষ্ট্র। ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশনের অর্থায়ন বা ডিএফসি অর্থায়নে বাংলাদেশকে যুক্ত করা নিয়ে আলোচনা করবে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র। যদিও ডিএফসি অর্থায়ন পাওয়ার পূর্বশর্ত বাংলাদেশ পূরণ করতে পারেনি এখনও।
গতকাল সোমবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জুলাই মাসের বিভিন্ন সফরের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উজরা জিয়া বাংলাদেশ আসছেন এবং তাঁকে আমরা স্বাগত জানাই। বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের খুব গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকায় বিশ্বের নজর বেড়েছে। ফলে সবাই তাদের সঙ্গে আমাদের রাখতে চায়।
বাংলাদেশ চীনের ঋণ ফাঁদে পড়ে যাবে বলে একটি ভুল খবর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এসেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, চীনা ঋণ ফাঁদে পড়াসহ চীনের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ এমন খবর ছড়িয়েছিল। এটি শুনে অনেকের জ্বর উঠেছে। সেই সঙ্গে তারা খুব ভয় পেয়েছে, বাংলাদেশ অন্যদিকে যায় কিনা। তবে বাংলাদেশ এটি পরিষ্কার করেছে যে বাংলাদেশ এক স্বাধীন ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি অনুসরণ করছে এবং বাংলাদেশ কারও লেজুড় নয়।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সফর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলো দেখলে বোঝা যায়, এগুলো মডেল নির্বাচন। আমরা চাই সহিংসতামুক্ত নির্বাচন। এ ধরনের নির্বাচন চাইলে প্রতিটি দল ও মতের আন্তরিকতা থাকতে হবে। শুধু সরকার ও নির্বাচন কমিশন চাইলেই নির্বাচন সহিংসতামুক্ত হবে না। সকল রাজনৈতিক দলের এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
উজরা জিয়ার সফরে অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাই। আমরা আমাদের কথাগুলো জানাব। তারা যদি অন্য কোনোভাবে সহযোগিতা করতে পারে, তাহলে তা স্বাগত জানাব। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়াতে চাই। কারণ ভুল ধারণা থেকে র্যাবকে তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিয়েছে। ভিসা নীতি নিয়ে আলোচনা হবে কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে না। বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। এটি নিয়ে কিছু সাংবাদিক চিন্তিত। এছাড়া সবচেয়ে বেশি চিন্তিত হচ্ছেন আমলারা, কিছু এনজিও নেতৃত্ব, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, কিছু ব্যবসায়ী। যাঁদের সন্তানেরা সেখানে পড়াশোনা করছেন, যাঁদের অর্থ সেখানে রয়েছে বা যাঁরা অবসরের পর সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন–তাঁরা ভিসা নীতি নিয়ে চিন্তিত।
আগামী ৮ জুলাই ঢাকা পৌঁছাবে ইইউ প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। দলটি আগামী জাতীয় নির্বাচনপূর্ব সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবে। তারা মূলত নির্বাচনের সময়ে পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা; নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সহিংসতামুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে। ইইউর প্রতিনিধি দলের এ সফরটি হবে ১০ দিনের। বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢাকার ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, প্রাক-নির্বাচনী পর্যেবক্ষক দলটি নির্বাচনের প্রস্তুতি দেখবে। সেই সঙ্গে ইইউর পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসতে পারবেন কিনা, সেটি খতিয়ে দেখবেন। সেটিও অবশ্য নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা আসতে পারবেন মর্মে সরকারের থেকে নিশ্চয়তার ওপর নির্ভরশীল।
ইইউর মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমোন গিলমোর আয়ারল্যান্ডের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী। এর আগে ২০১৮ সালে তিনি বাংলাদেশ সফর করেছেন। সে সময় তিনি রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছিলেন। সম্প্রতি ব্রাসেলসে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়েছে। মূলত রোহিঙ্গাশিবির পরিদর্শনের জন্য তিনি বাংলাদেশ আসছেন। এছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে ঢাকায় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
ইইউর মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমোন গিলমোরের সফরটি নিশ্চিত করে চার্লস হোয়াইটলি বলেন, তাঁর সফরের মূলে থাকবে রোহিঙ্গাশিবির পরিদর্শন। সফরে ২০১৮ সালের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি তিনি পর্যালোচনা করে দেখবেন। তাঁর সফরকালে বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে কিনা– জানতে চাইলে ইইউ রাষ্ট্রদূত নেতিবাচক উত্তর দেন। তিনি বলেন, এটি মানবাধিকার নিয়ে সাধারণ সফর। যেহেতু তিনি মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি, সেহেতু অংশীদার দেশগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ আলোচনা করেন। বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট কোনো মানবাধিকার বিষয় নিয়ে তিনি সফর করছেন না।
তাসনিম মহসিন