জনগণ ভোট দিতে পারলেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়

0
135

নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের মামলা-সংক্রান্ত সব দলিল দস্তাবেজ-কাগজপত্র খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞ পাঠানোর জন্য বিবৃতি দেওয়া বিশিষ্টজনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ভদ্রলোকের (ড. ইউনূস) যদি এতই আত্মবিশ্বাস থাকত যে তিনি কোনো অপরাধ করেননি, তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবৃতি ভিক্ষা করে বেড়াতেন না। তবে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। বাংলাদেশে সবকিছু আইনমতো চলে। আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে।

প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন-পরবর্তী জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেছেন, আগামী নির্বাচনে খুনিদের নয়, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণটা কার? ভোটচোরদের? ভোটডাকাতদের? খুনি, জাতির পিতার হত্যাকারী ও একুশে আগস্টের হামলাকারীদের? এদের মানুষ চায়? তাদের প্রতি মানুষের ঘৃণা আছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তা প্রমাণ হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে জনগণ সব নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। দেশ কীভাবে চলবে, তার সিদ্ধান্ত জনগণই নেবে। আওয়ামী লীগ জনগণের কল্যাণে কাজ করছে। আমি জনগণের স্বার্থে কাজ করছি। এখন জনগণ চাইলে ভোট দেবে, না চাইলে দেবে না। সে সিদ্ধান্ত জনগণকেই নিতে হবে। তবে আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করে যাব।’

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। এ ছাড়া বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সম্পাদকসহ গণমাধ্যমে কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিক, মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্য ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম। বিশেষজ্ঞ পাঠালে আরও অনেক কিছু বেরোবে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের মামলা নিয়ে উদ্বেগ জানানো বিবৃতি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে  প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিবৃতিদাতারা বাংলাদেশে এসে নিজেরা দেখুক। বিশেষজ্ঞ পাঠাক। আইনজীবী পাঠাক। যাঁর বিরুদ্ধে মামলা, তাঁর সব দলিল দস্তাবেজ-কাগজপত্র সবকিছু খতিয়ে দেখুক– কোনো অন্যায় আছে কিনা। এখানে কী কী অসামঞ্জস্য আছে, নাকি অন্যায়ভাবে মামলা দেওয়া হয়েছে। তারা বিবৃতি না দিয়ে বিশেষজ্ঞ পাঠালে আরও অনেক কিছু বেরোবে। যেটায় হয়তো কখনও হাতও দেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনা স্মরণ করিয়ে দেন, ট্যাক্স দেওয়া সকল নাগরিকের দায়িত্ব। ট্যাক্স ফাঁকিতে যদি কেউ ধরা পড়ে, তাকে তো ট্যাক্স ফেরত দিতে হবে।

চলমান মামলার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা যায় না– এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার খুব অবাক লাগছে, কেউ যদি ট্যাক্স না দেয় আর শ্রমিকের অর্থ আত্মসাৎ করে, আর শ্রমিকের পক্ষে যদি শ্রম আদালতে মামলা করা হয়, আমাদের কি সেই হাত আছে যে আমরা মামলা বন্ধ করে দেবো? তা ছাড়া বাংলাদেশে তো আমরা চলমান মামলা নিয়ে আলোচনাও করি না। বাংলাদেশের কোম্পানি আইনে আছে, লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিকের ওয়েলফেয়ারে দিতে হবে। এখন যদি কেউ সেটা না দেয়, যদি শ্রমিকরা মামলা করে, মামলার পর যদি তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়, তার জন্য যদি তারা মামলা করে, সেই দায়িত্ব তো আমাদের না।’

শেখ হাসিনা বলেছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির বেতন হয় সরকারিভাবে। সরকারি বেতনভুক্ত একজন এমডি বিদেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কীভাবে ইনভেস্টমেন্ট করেন? ব্যবসা-বাণিজ্য করেন? বিবৃতিদাতারা কি এই কথা একবারও জিজ্ঞেস করেছেন? তারা কি খোঁজ নিয়েছেন– কোত্থেকে এত টাকা এলো? টাকাটা পেলেন কোথায়? কীভাবে টাকাটা উপার্জন করলেন– বাংলাদেশের কেউ কি জিজ্ঞেস করেছেন?

আমি কে মামলা প্রত্যাহার করার

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘বাইরের থেকে বিবৃতি এনে মামলা প্রত্যাহারের দাবি! আমি কে মামলা প্রত্যাহার করার? এখানে আমার কোন অধিকারটা আছে? তারা বিবৃতি দিয়ে কীভাবে মামলা তোলাবে– সেটা আমি নিজেও জানি না। মামলায় সরকারের কোনো হাত নেই। সরকার মামলা করেনি। মামলা করেছে শ্রমিকরা।’ ‘বিশ্বনেতৃবৃন্দের বিবৃতিতে বিচার প্রভাবিত হবে কিনা’– এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আদালত প্রভাবিত কেন হবে? আদালত স্বাধীনভাবেই কাজ করবে। কে বিবৃতি দিল-না দিল, সেটা আদালতের দেখার দরকারটা কী? আদালত ন্যায়বিচার করবে।

সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ

রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের নানা তৎপরতার কারণে আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে কেউ কেউ অনিশ্চিত পরিস্থিতি দেখছেন। কেউ কেউ বলছেন, দেশে হচ্ছে কী? হবে কী? এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। আমরা কেবল মেগা প্রকল্পই উদ্বোধন করছি না। খাদ্য উৎপাদনেও দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাছ, সবজি– কোনটার অভাব? ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, ব্রিজ– এগুলো কার জন্য? জনগণই তো এর সুফল ভোগ করে। আগে যেখানে দুই-তিন ঘণ্টা বসে থাকতে হতো, মেট্রোরেলের কল্যাণে এখন সেই পথ ১০ মিনিটে পাড়ি দেওয়া যাচ্ছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন করা হবে। এগুলো কার কাজে লাগে? জনগণের স্বার্থেই তো সব কিছু করা হয়েছে। একশ্রেণির মানুষের কাছে এ সবের কিছুই ভালো লাগে না। একটি দল আছে, তারা দেশ চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের তো মনোবেদনা থাকবেই। তাদের কাছে তো সব কিছুই খারাপ লাগবে। তাদের নিয়ে তো কিছু বলার নেই।

শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, আওয়ামী লীগ জনগণের জন্য কাজ করে। ১৫ বছর আগে দেশ কোথায় ছিল; এখন কোথায় আছে? এত দ্রুত সময়ে এত পরিবর্তন আনা কি সহজ কাজ? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগের আদর্শ আছে; নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা আছে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাও আছে আওয়ামী লীগের। সেই পরিকল্পনা আছে বলেই ক্ষমতায় এলে দেশের কল্যাণে কাজ করে যায় আওয়ামী লীগ।

তখন কোথায় ছিল নীতিকথা

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যখন সামরিক শাসকরা নির্বাচন করত, তখন এই সুর কোথায় ছিল? এ নিয়ে যারা বিবৃতি দেন, তারা তখন কোথায় ছিলেন? জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া ভোট চুরি করল; তখন কোথায় ছিল নীতিকথা? সেই ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, ছবিসহ জাতীয় পরিচয়পত্র ও নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। অথচ ভোট চুরির মাধ্যমে যাদের উত্থান, তাদের কাছ থেকে এখন ভোটের স্বচ্ছতার দাবি শুনতে হচ্ছে। যাদের আমলে একটা কথা ছিল– ১০টা হোন্ডা, ২০টা গুন্ডা, নির্বাচন ঠান্ডা।

অপপ্রচারে কান না দেওয়ার আহ্বান

সর্বজনীন পেনশন নিয়ে অপপ্রচারকারীদের অর্বাচীন হিসেবে আখ্যায়িত ও অপপ্রচারে কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যারা পরশ্রীকাতরতায় ভোগে, যারা সব সময় হতাশায় থাকে, যারা নিজেরা কিছু করতে পারে না, যারা সম্পূর্ণ অর্বাচীন– এই অর্বাচীনদের কথায় কান দিলে চলবে না। সরকারি অফিসাররা পেনশন পান। সাধারণ জনগণ পেনশন ব্যবস্থায় নেই। তাই বৃদ্ধ বয়সে নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্যই সর্বজনীন পেনশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি সর্বজনীন পেনশন নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো প্রসঙ্গে বলেছেন, এই টাকা নিয়ে ইলেকশন ফান্ড করতে হবে– ওই রকম দৈন্যে পড়েনি আওয়ামী লীগ। জনগণ নিজের খেয়েই নৌকায় ভোট দেয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় যে টাকাটা রাখা হবে, সেই টাকাই ধীরে ধীরে ম্যাচিউরড হবে। বয়সসীমাও দেওয়া আছে। এর পর থেকে টাকা তোলা যাবে, চিকিৎসা বা জীবন-জীবিকার কাজে লাগবে। এই টাকা অন্য কোনো দিকে যাওয়ার উপায় নেই। কারণ টাকাটা সরকারি কোষাগারে যাচ্ছে। পেনশনের যে স্কিম, সেই স্কিমে টাকাটা থেকে যাবে। এটা যে কেউ তুলে নিতে পারবে না। ব্যবহারও করতে পারবে না। এটা জনগণের জন্য কল্যাণমুখী একটি পদক্ষেপ।

সিন্ডিকেট ভাঙা যাবে না, এমন কিছু বাণিজ্যমন্ত্রী বললে তাঁকেও আমি ধরব

প্রধানমন্ত্রী বাজার সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বলেছেন, ‘সিন্ডিকেট ভাঙা যাবে না– এটা কোনো কথা না। কে কত বড় শক্তিশালী, আমি তা দেখব। সিন্ডিকেট ভাঙা যাবে না, এমন কিছু বাণিজ্যমন্ত্রী বললে তাঁকেও আমি ধরব।’ তিনি আরও বলেছেন, একটি চক্র সুযোগ পেলেই কারসাজি করে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর চেষ্টা করে। তা জানার পর পরই সরকার ব্যবস্থা নেয়। ফলে দ্রব্যমূল্য কমে। তিনি এক ইঞ্চি জায়গাও পতিত না রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রতিটি গ্রাম এখন শহরের মতো। গ্রাম এখন আর গ্রাম নেই। গ্রামের প্রত্যেক মানুষ নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামে বসেও মানুষ অনলাইনে কেনাবেচা করে। ব্যবসা-বাণিজ্য করে। সারাবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। ফলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। এটাই তো স্মার্ট বাংলাদেশ।

ব্রিকসের সদস্য হওয়ার চেষ্টাও করেনি বাংলাদেশ

ব্রিকসে বাংলাদেশের সদস্যপদ-সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘চাইলে পাবো না’ সেই অবস্থাটা নয়। প্রতিটি কাজেরই একটা নিয়ম থাকে। আমরা সেই নিয়ম মেনে চলি। আমরা যখন শুনলাম, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক হচ্ছে। সেখানেই আগ্রহ ছিল আমাদের। সেখানে আমরা যুক্ত হতে চেয়েছিলাম। ব্রিকসের সদস্য হওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে, ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনা করে ধাপে ধাপে সদস্য নেওয়া হবে এবং পর্যায়ক্রমে সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হবে। তবে প্রথমবারেই ব্রিকসের সদস্য হওয়ার চিন্তা ছিল না বাংলাদেশের। সেই রকম কোনো চেষ্টাও করেনি বাংলাদেশ।

শেখ হাসিনা বলেছেন, ব্রিকসের সদস্যপদ নিয়ে বিরোধী দল থেকে খুব হতাশা ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ নাকি ব্রিকসের সদস্যপদ পায়নি। বাংলাদেশ কিছু চেয়ে পাবে না, এটা কিন্তু ঠিক না। অন্তত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের যে মর্যাদা বর্তমানে তুলে ধরা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের সেই সুযোগ আছে। বিএনপির আমলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো অবস্থানই ছিল না বাংলাদেশের। ওই সময়ে বাংলাদেশ মানেই ছিল দুর্ভিক্ষ, ঝড়, বন্যার দেশ। হাত পেতে চলার দেশ। ভিক্ষা চাওয়ার দেশ। এখনকার বাংলাদেশ ভিক্ষা চাওয়ার দেশ না। সারাবিশ্বে বাংলাদেশ এখন মাথা উঁচু করে চলে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.