চীন থেকে কেন বিচ্ছিন্ন হতে পারছেন না ট্রাম্প ও বাইডেন

0
110
চীন ও যুক্তরাষ্ট্র

বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প খুব বেশি বিষয়ে একমত হন না। কিন্তু দুজনের মধ্যে একটি জায়গায় বেশ মিল। সেটা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য সম্পর্কের প্রসঙ্গ এলেই তাঁরা দুজন এক হয়ে যান। তাঁরা বিশ্বাস করেন, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির ওপর বেশি নির্ভরশীল।

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এখন তাই চীন থেকে উৎপাদন সরিয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ বা বন্ধুত্বপূর্ণ অঞ্চলে নিয়ে আসার বাণী ফেরি করে বেড়াচ্ছেন। ব্যবসায়ীদের কণ্ঠে অবশ্য ইতিবাচক কথাই শোনা যায়। তাঁরা চীনের দুর্বল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়ে প্রকৃত অর্থেই উদ্বিগ্ন, দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বলাই বাহুল্য।

তবে উৎপাদন কার্যক্রম চীন থেকে সরিয়ে আনার এই বিষয় অনেক ক্ষেত্রে স্রেফ কথার চেয়ে বেশি নয়। গত বছর ইকোনমিস্ট জানিয়েছিল, চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়টি বস্তুত ভ্রমাত্মক। সেই সংবাদে বলা হয়েছিল, ভালোভাবে খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার হচ্ছে, যদিও নানা ধরনের ছলচাতুরীর মাধ্যমে উভয় দেশই তা আড়াল করছে।

এরপর তাদের হাত যেসব তথ্য-উপাত্ত এসেছে, সেগুলো ঘেঁটে দ্য ইকোনমিস্ট দেখেছে, এই কথাটা ঠিক। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অর্থনীতি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে না। এমনকি সরবরাহব্যবস্থায় বিশেষ কিছু পরিবর্তনের কারণে দেশ দুটি বরং পরস্পরের আরও কাছাকাছি এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য সম্পর্ক বহুমুখী। পণ্য বাণিজ্যের হিসাব রাখা যায়, কিন্তু দেশ দুটির বাণিজ্যের প্রকৃত হিসাব পেতে হলে সেবা বাণিজ্যের হিসাবও রাখতে হবে। যেমন মার্কিন নাগরিকদের চীনা অ্যাপ ব্যবহার ও চীনাদের মার্কিন চলচ্চিত্র প্রীতি। কিন্তু এসবের হিসাব রাখা কঠিন।

তবে ট্রাম্প ও বাইডেনের খুশি হওয়ার মতো কিছু তথ্য দেওয়া যেতে পারে। গত বছর চীনকে হটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস হয়েছে প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকো। ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা আমদানি ধারাবাহিকভাবে কমছে; এই সময় চীন থেকে তাদের আমদানি এক-তৃতীয়াংশ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এর মধ্যে বড় একটি অংশ কমেছে ট্রাম্পের জমানায়। ২০১৮ সালে তিনি যখন শুল্ক আরোপ করেন, তার পর থেকে এই পতন ত্বরান্বিত হয়েছে।

চীন থেকে আমদানি কমার আরেকটি কারণ হচ্ছে, চীনের ভূরাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ–সংক্রান্ত ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ। সেটা হলো, চীন যদি তাইওয়ান আক্রমণ করে, তাহলে এশিয়ার সরবরাহব্যবস্থার বড় একটি অংশ অকার্যকর হয়ে যাবে।

কিন্তু এ জাতীয় পরিসংখ্যান দিয়ে পুরো গল্প বোঝা যায় না। কেন সেটা বোঝা যায় না, তা বুঝতে হলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ থেকে শুরু করতে হবে, যার বড় একটি অংশ বাইডেন অপরিবর্তিত রেখেছেন। ২০১৮ সালে ট্রাম্প চীনা পণ্যে শুল্ক আরোপের আগপর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যানে দেখা যেত, যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, সেটা চীনের পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশি। কিন্তু এখন ঠিক এর উল্টো ঘটনা দেখা যাচ্ছে।

চীনের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রপ্তানি বেড়েছে মোট ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলারের। অথচ মার্কিনরা বলছে, এই সময় চীন থেকে আমদানি কমেছে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলারের। কথা হচ্ছে, চীনাদের পরিসংখ্যান ঠিক হলেও যুক্তরাষ্ট্র দেশটি থেকে এখন যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করছে, তার হিস্যা কমেছে। যদিও তার হার খুব একটা বেশি নয়।

এই পরিস্থিতি সম্পর্কে অ্যাবসোলিউট স্ট্র্যাটেজি রিসার্চের প্রধান অ্যাডাম উলফ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকদের আমদানির তথ্য লুকানোর পেছনে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার বিষয় আছে। এই বাস্তবতায় তিনি মনে করেন, মার্কিন আমদানিকারকেরা চীনা পণ্য আমদানির পরিসংখ্যান অন্তত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কম দেখায়। একই সময় চীন সরকার রপ্তানিকারকদের কর কমিয়েছে; সে জন্য দেশটির ব্যবসায়ীদের এখন রপ্তানির পরিসংখ্যান কমিয়ে দেখানোর প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই কমেছে।

বিচ্ছিন্নতা বাস্তবে নয়
দ্য ইকোনমিস্ট ৩৫টি শিল্পের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদনের শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ কাঁচামাল বা রসদ আসে চীনের বেসরকারি কোম্পানিগুলো থেকে। এই হার খুব বেশি না হলেও জার্মানি ও জাপানের তুলনায় বেশি, জার্মানির ছিল শূন্য দশমিক ৩৮ শতাংশ আর জাপানের শূন্য দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০২২ সালের মধ্যে চীনের হিস্যা ১ দশমিক ০৬ শতাংশে উঠে যায়; সেই তুলনায় জার্মানি ও জাপানের তেমন একটা বাড়েনি।

এই প্রবণতার পেছনে ঠিক কী আছে, তা বোঝা কঠিন। হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র যে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দিয়েছিল, তার বদৌলতে এটা হয়েছে। সে কারণে চীনের উপকরণ আমদানি করা আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সৌরবিদ্যুতের মধ্যবর্তী পণ্যের জন্য চীনের দ্বারস্থ না হয়ে উপায় নেই।

দ্য ইকোনমিস্টের হিসাবে, ২০১৯ সালের পর চীনের অন্তর্বর্তীকালীন পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৩২ শতাংশ, যদিও তৈরি পণ্য রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণ হলো, ভারত ও ভিয়েতনামে রপ্তানি বেড়ে যাওয়া, যারা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিয়পাত্রের মতো। অবস্থাদৃষ্টে দ্য ইকোনমিস্ট মনে করছে, ভিয়েতনাম ও ভারত কার্যত চীনের অন্তর্বর্তীকালীন পণ্য দিয়ে তৈরি পণ্যের মোড়কজাতকরণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র যতই বাগাড়ম্বর করুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মার্কিন বাজার হারাতে নারাজ। রপ্তানিতে আবার জোর দিচ্ছে তারা। সংকটগ্রস্ত আবাসন খাত থেকে ঋণ সরিয়ে উৎপাদন খাতে প্রবাহিত করার নির্দেশনা দিয়েছে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

চীনের সরবরাহব্যবস্থা মার্কিন অর্থনীতিতে এখন অতটা দৃশ্যমান না হলেও মার্কিন অর্থনীতির জন্য তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সেই গুরুত্ব থাকবে কি না, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে চীনের পণ্যে বিপুল পরিমাণে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। এ ধরনের পদক্ষেপের কারণে অনেক কোম্পানি চিরতরে চীন থেকে উৎপাদন সরিয়ে নিতে উৎসাহিত হতে পারে। এরপর চীন তাইওয়ান বা অন্য কোথাও সামরিক আগ্রাসন চালালে একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তা ছাড়া এই সময় অন্যান্য যেসব দেশ চীনের বিকল্প হওয়ার চেষ্টা করছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ চীনের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের চীন নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসার আগপর্যন্ত শিগগিরই বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে না। অনেক দেশ এখন দুই নৌকায় পা রেখে চলতে চাইছে, অর্থাৎ চীনের বিনিয়োগ দিয়ে পণ্য তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা। চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও দক্ষতাই বিদ্যমান বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট। বিচ্ছিন্ন হওয়ার আহ্বান বাগাড়ম্বর হিসেবে শক্তিশালী হতে পারে, তবে বাস্তবে বিষয়টি ঠিক তা নয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.